দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকা, সহনশীলতার অভাব, মাদকের ব্যবহার এবং যৌতুকের দাবির মুখে চট্টগ্রামে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। বছরে দেড় থেকে দুই হাজারের বেশি ডিভোর্স আবেদন নিষ্পত্তি হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের পারিবারিক আদালতে। আর প্রতি বছর আবেদন জমা পড়ছে তিন থেকে চার হাজারের বেশি। চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে বিয়ে বিচ্ছেদ চেয়ে সিটি কর্পোরেশনের সালিশি আদালতে আবেদন করেছেন তিন হাজার ৫৭২ জন। সে হিসাবে ২৪ ঘণ্টা বা একদিনে গড়ে ১৪টি বিচ্ছেদের আবেদন পড়েছে এ আদালতে। এছাড়া আবেদনকারীদের বেশিরভাগই নারী।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সালিশি আদালতের স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌস বলেন, সংসার ভাঙার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। উচ্চ থেকে নিম্ন সব শ্রেণিতেই বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। তবে গত বছরের তুলনায় সেই হার এ বছর বেশি।
তিনি বলেন, বিয়ে বিচ্ছেদের পেছনের কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়— মাদকাসক্তি, স্মার্টফোনে আসক্তি, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কের কারণেই বেশিরভাগ বিচ্ছেদ ঘটে। এর পাশাপাশি সহনশীলতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবও লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া অর্থনৈতিক অস্থিরতাও একটি বড় কারণ। বরপক্ষের যৌতুক ও কনেপক্ষের দেনমোহরের চাপও এর জন্য দায়ী।
জাহানারা ফেরদৌস আরো বলেন, করোনাকালে বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে। এর পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। করোনায় দীর্ঘদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে হয়তো একে অন্যের দোষ-ত্রুটি মেনে নিতে পারছেন না। এ কারণেও বিয়ে ভাঙছে। তবে মানুষের মধ্যে সহনশীলতা অনেক কমে গেছে। আবেদনের পর অনেক সময় দুই পক্ষকে বুঝিয়ে সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। যদিও সেই সংখ্যা অনেক কম।
চসিকের সালিশি আদালতে জমা পড়া বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, উচ্চ থেকে নিম্ন সব আবেদনের ভাষা প্রায় একই।
নারীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখানো হয়— যৌতুকের জন্য নির্যাতন, স্বামী পরনারীতে আসক্তি কিংবা দ্বিতীয় বিয়ে, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, স্বামীর মাদকাসক্তি ইত্যাদি।
অন্যদিকে পুরুষের পক্ষ থেকে— স্ত্রীর পরকীয়া, স্বামীর অবাধ্য হওয়া, যৌথ পরিবারে থাকতে অসম্মতি, সন্তান না হওয়া ইত্যাদি।
পরিংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালে চসিকের সালিশি আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করেন চার হাজার ৮৫৪ জন। ২০১৯ সালে চার হাজার ৫৫০, ২০১৮ সালে করেন চার হাজার ৩৩১, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৯২৮, ২০১৬ সালে তিন হাজার ৯৬১, ২০১৫ সালে তিন হাজার ৪৮৬ ও ২০১৪ সালে তিন হাজার ২৬৮ জন বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করেন। এক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি আবেদন ছিল নারীদের। অর্থাৎ বিয়ে বিচ্ছেদে নারীরাই এগিয়ে বলা চলে।
নারীরা উদ্যোগী হয়ে বেশি তালাক দিচ্ছেন তথ্যটি কৌতুহলোদ্দীপক, তবে চমকে দেওয়ার মতো নয়। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক মূল্যবোধের বজ্র-আঁটুনি কাটাতে সাহস করে তারা দুই কদম বেশি স্বপ্রণোদিত হয়েছেন বলে অনুমান করা যায়।
নিয়ম অনুযায়ী, বিয়ে বিচ্ছেদে ইচ্ছুক পুরুষ বা নারীকে প্রথমে তার সিদ্ধান্তের কথা লিখিতভাবে (তালাক নোটিশ) সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে জানাতে হয়। যাকে তালাক দিতে ইচ্ছুক তাকেও সেই নোটিশ পাঠাতে হয়। আবেদন পেয়ে মেয়র নোটিশটি সালিশি আদালতে পাঠিয়ে দেন। আদালতে মেয়রের পক্ষে নিযুক্ত থাকেন স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট (যুগ্ম জেলা জজ)। আদালত বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর করার আগে দুই পক্ষকে তিন মাসে তিনবার নোটিশ দেন। দুই পক্ষের কোনো পক্ষ বা দুই পক্ষই হাজির হলে সমঝোতার চেষ্টা করে আদালত। কিন্তু সমঝোতা না হলে আইন অনুযায়ী ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিচ্ছেদের অনেকগুলো কারণ থাকে। ইদানিং সংসার ভাঙ্গার প্রধানত দুই ধরনের কারণ আমরা দেখে থাকি। প্রথমত, স্বামী-স্ত্রীর যে মেলবন্ধন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ধৈর্যশীলতা, একে অপরকে বোঝার ক্ষমতা এবং সংসারের খুটিনাটি বিষয়গুলো মেনে বা মানিয়ে নেয়া। এছাড়া নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এগুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। এখনকার বাবা মায়েরা তাদের একমাত্র ছেলে বা মেয়ের বেশি সুখ দেখতে গিয়ে এই সমস্যাটা হচ্ছে। যে সকল পরিবারের একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রয়েছে সেসব পরিবারে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। মেয়েকে তার মা বা পরিবারের অন্য কেউ প্রভাবিত করে।
দ্বিতীয়ত, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তারা বিভিন্ন পরকীয়াজনিত সম্পর্কে জড়াচ্ছে এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে পরকীয়ার কারণে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে বিয়ের আগে ছেলে বা মেয়ের পরিবারের উচিৎ সন্তানদের কাউন্সিলিং করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধৈর্যশীলতা, সহনশীলতা ইত্যাদির ওপর মোটিভেশনাল কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করা। ছেলে এবং মেয়ের পরিবারের উভয়ের প্রতি ডমিনেটিং মনোভাবটা যতোদিন পর্যন্ত না কমানো যাবে ততোদিন এটা থামবে না।
তারা বলেন, করোনার কারণেই যে বেড়েছে, সে রকম দাবি করার সুযোগ কম। নারীরা উদ্যোগী হয়ে বেশি তালাক দিচ্ছেন তথ্যটি কৌতুহলোদ্দীপক, তবে চমকে দেওয়ার মতো নয়। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বেড়েছে। এ কারণে পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক পারিবারিক মূল্যবোধের বজ্র-আঁটুনি কাটাতে সাহস করে তারা দুই কদম বেশি স্বপ্রণোদিত হয়েছেন বলে অনুমান করা যায়। বাস্তবতা এই যে বিশ্বায়নের প্রভাবে বাংলাদেশে দাম্পত্য সম্পর্কে জটিলতা বাড়বে, বিবাহবিচ্ছেদও বাড়বে।
আরও বলেন, এই বাস্তবতা অস্বীকার না করে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে উদ্ভুত সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে ভাবা উচিত। পৃথিবীর অনেক দেশে অর্ধশতক আগে থেকেই পরিবার ও শিশুকল্যাণ কর্মসূচি চালু রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেভাবে শুরু হয়নি। বিবাহবিচ্ছেদ ‘মহামারির মতো’ বেড়ে যাচ্ছে ভেবে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং পরিবার ও শিশু কল্যাণ কর্মসূচিকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত করা দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১২
আপনার মতামত জানানঃ