আতঙ্কের নতুন নাম ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস। এই ভাইরাসের কবলে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ৯ জন মারা গেছেন। এই ভাইরাস সংক্রমণ হয় মশার কামড় থেকে। এর কোনো প্রতিকার নেই। এতে একজন মানুষের প্যারালাইসিসও হয়ে যেতে পারে। এ বছর ২৯টি রাজ্যে এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়েছে। এ জন্য নিউ ইয়র্কের কর্মকর্তারা মশার এই প্রজনন মৌসুম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এ বছর প্রথমে ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে প্রথম মৃত্যুর রিপোর্ট নিশ্চিত করা হয়েছে লস অ্যানজেলেস থেকে। সেখানে অজ্ঞাত একজন অধিবাসী স্নায়ুবিক সমস্যায় ভুগে মারা গেছেন।
দ্বিতীয় মৃত্যু হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেখানে ৮৬ বছর বয়স্ক ব্যক্তি বসবাস করতেন ডোনাল্ড স্ট্রিটে। তিনি শুক্রবার মারা গেছেন। তার ছেলে বলেছেন, তিনি বাসার পিছনে বসে ছিলেন। সেখান থেকে আক্রান্ত মশায় তাকে কামড়েছে।
তবে সবার উপরে আছে অ্যারিজোনা রাজ্য। সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৯ জন। মারা গেছেন দু’জন।
২৯টি রাজ্যে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। এ বছর এখন পর্যন্ত এর মধ্যে ৬টি রাজ্যে মৃত্যুর রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে টেক্সাসে দু’জন মারা গেছেন। নিউজার্সি, ইডাহো এবং আরকানসাসে মারা গেছেন একজন করে। কলোরাডো রাজ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৪ জন। তবে সেখানে কেউ তারা যাননি।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাঝারি তাপমাত্রায় ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের মতো রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক এনএইচএস বলেছে, যুক্তরাজ্যে এখনও কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হননি। খুব কম সংখ্যক মানুষই এই রোগ নিয়ে যুক্তরাজ্যে এসেছেন।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাঝারি তাপমাত্রায় ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসের মতো রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
তবে এই ভাইরাস সংক্রামক নয়। স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, কিছু মানুষের মধ্যে মাঝারি ফ্লুর মতো লক্ষণ দেখা দেয়, ত্বকে ফুসকুড়ি ওঠে, এমনকি অসুস্থ বোধ করতে পারেন। তবে এর কোনো প্রতিকার বের হয়নি। যেসব মানুষের বয়স ৫০ বছরের ওপরে অথবা যাদের ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাদের জন্য এই রোগটির ঝুঁকি খুব বেশি। এ জন্য নিউ ইয়র্কের পাঁচটি বরো’তে এই ভাইরাস পাওয়া যাওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছেন নিউ ইয়র্কের সিনেটর চাক শুমার।
ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস কী?
ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস বা ডব্লিউএনভি। এটাই নাইল ভাইরাসের পুরো নাম। এটি একটি মশাবাহিত রোগ। সাধারণত কিউলেক্স মশা থেকে এই রোগ ছড়ায়। মূলত পাখির দেহ থেকে মশার মাধ্যমে এই ভাইরাস ঢোকে মানুষের শরীরে। আফ্রিকা, ইউরোপ, নর্থ আমেরিকা ও পশ্চিম এশিয়ায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব সবথেকে বেশি।
কোথা থেকে এল
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ১৯৩৭ সালে আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডার ওয়েস্ট নাইল অঞ্চলে একজন নারীর শরীরে প্রথম এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। ১৯৫৩ সালে নীল বা নাইল নদ উপত্যকার পাখির (কাকজাতীয়) শরীরে এই ভাইরাস চিহ্নিত হয়।
গত ৫০ বছরে বিশ্বের অনেক দেশে এই ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় গ্রিস, ইসরায়েল, রুমানিয়া, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে। প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে এমন এলাকাগুলো পরিযায়ী পাখির বড় কোনো চলাচলের পথ নয়। আফ্রিকা, ইউরোপের কিছু অংশ, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় এই রোগের সংক্রমণ দেখা দেয়।
১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে এই ভাইরাস আসে ইসরায়েল ও তিউনিসিয়া থেকে এবং দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে এর প্রকোপ চলতে থাকে ২০১০ সাল পর্যন্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও রোগ প্রতিরোধ প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে মশাবাহিত রোগের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস। এই ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো টিকা নেই এবং আক্রান্ত মানুষের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। আক্রান্ত প্রতি পাঁচজনের একজনের জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়। আক্রান্ত ১৫০ জনের মধ্যে একজনের পরিস্থিতি তীব্র হয়, মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে।
কীভাবে ছড়ায়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, কোনো সংক্রামিত পাখির কাছ থেকে মশা এই ভাইরাস পায়। কয়েক দিনে মশার শরীরে ভাইরাসের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এরপর ওই মশা কোনো মানুষ বা পশুকে কামড়ালে সংক্রমণ ছড়ায়। এ পর্যন্ত মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোনো ঘটনার নজির দেখা যায়নি। অন্যদিকে মা থেকে শিশুতে সংক্রমণেরও কোনো নজির নেই। মশা নিয়ন্ত্রণই এই ভাইরাস প্রতিরোধের প্রধান উপায়।
রোগের লক্ষণ ও শনাক্ত করা
আক্রান্ত ৮০ শতাংশ মানুষের শরীরে কোনো রোগের লক্ষণ দেখা দেয় না। আক্রান্ত ২০ শতাংশের ওয়েস্ট নাইল জ্বর হয়। এর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, মাথাব্যথা, পরিশ্রান্তভাব, শরীরে ব্যথা, বমিভাব, মাঝেমধ্যে শরীরে র্যাশ দেখা দেয়।
ওয়েস্ট নাইল জ্বর মারাত্মক হলে মাথাব্যথা, তীব্র জ্বর, ঘাড় শক্ত হওয়া— এসব উপসর্গ দেখা দেওয়ার পাশাপাশি মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়, পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিও আছে।
অন্তত পাঁচ ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে এই ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে।
জানা গেছে, দু–একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছাড়া এই ভাইরাস শনাক্ত করার প্রযুক্তি কারও কাছে নেই।
সব থেকে বেশি বিপদ হয় কখন?
নাইল ভাইরাস যদি কোনও ক্রমে মস্তিষ্কে পৌঁছে যায় তাহলেই বিপদ। মস্তিষ্কে পৌঁছলেই ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। এই সংক্রমণ হলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এমনকি সেই সংক্রমণ মস্তিষ্ক ছাড়িয়ে পড়ে সুষুম্নাকাণ্ডে। যার জেরে মানবশরীরের স্নায়ুতন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে।
কাদের বিপদ বেশি?
যে সব মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারা সহজেই এই রোগের শিকার হন। সাধারণত শিশু ও বয়স্ক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়। তাই শিশু ও বয়স্কদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সবথেকে বেশি।
ওযুধ কী?
মানুষের দেহে এই রোগ হলে তা নিরাময়ের কোনও ওষুধ বা ভ্যাকসিন এখনও পর্যন্ত নেই। স্নায়ুতন্ত্র যাতে পুরোপুরি বিকল হয়ে না পড়ে সে জন্য নিউরো-ইনভেসিভ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
সঙ্গে বিভিন্ন লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের মাধ্যমে ওই রোগের মোকাবিলা করা হয়। তাই এই রোগ থেকে বাঁচার সবথেকে ভাল উপায় মশার কামড় থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৩৬
আপনার মতামত জানানঃ