এরা শ্মশানে চারিদিকে চিতায় আগুনে পুড়তে থাকা লাশের পাশেই যৌনমিলনে লিপ্ত হন। এরা নগ্ন হয়ে ঘুরে বেড়ান, মানুষের মাংস খান এবং নরকংকালের খুলি থেকে পান করেন মেতে থাকেন গাঁজায়। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে অঘোরি বা নাগা সাধুদের কথা। এদের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। মহেঞ্জাদারো জনপদের মুদ্রার চিত্রে এই নাগা সাধুদের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। এই চিত্রগুলোতে দেখা যায়, নাগা সাধুরা পশুপতিনাথ রূপে ভগবান শিবের উপাসনা করছে।
অঘোরি শব্দটা জানা যায় আঠারো শতক থেকে। এই হিন্দু সাধুরা কাপালিকদের অনেক নিয়ম কানুন অনুসরণ করে। নরমুন্ডু বহনকারী কাপালিকদের সম্পর্কে কিন্তু জানা যায় সেই সপ্তম শতক থেকেই। কাপালিকরা নরবলির প্রথায় বিশ্বাস করতো। কিন্তু এদেরকে এখন আর দেখা যায় না।
অন্য হিন্দু জাতের মতো অঘোরিদের সমাজকে খুব সুসংগঠিত বলা যাবে না। বেশিরভাগ সময় এরা বাস করে দূরের কোনো জনবিচ্ছিন্ন এলাকায়। বাইরের দুনিয়ার লোকদের এরা খুব বিশ্বাস করে না। তারা এমনকি তাদের নিজেদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে না।
অঘোরিরা সাধারণত আসে সমাজের তথাকথিত ‘নীচু জাতের’ লোকদের মাঝ থেকে। তবে বুদ্ধিবৃত্তির বিচারে এদের মধ্যেও বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ আছে। একজন অঘোরি নেপালোর রাজার উপদেষ্টা পর্যন্ত হয়েছিলেন।
আবার মধ্যযুগীয় কাশ্মীরী কাপালিকতন্ত্র থেকেই অঘোরিদের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। এদের প্রাচীন নাম ‘কালমুখ’। তাছাড়া কিনারাম’র ঐতিহ্যের কথা সব অঘোরিই স্বীকার করে।
এক হিসেবে দেখলে অঘোরিরা শক্তির আরাধক। কালী বা তারা’র উপাসনাই তারা করে থাকে। কিন্তু তাদের আদর্শ শিবত্ব। এই জায়গায় মূলধারার শাক্ত তান্ত্রিকদের সঙ্গে তারা সহমত। তাদের আরাধ্য পুরুষ দেবতাদের মধ্যে শিব ছাড়াও কালভৈরব, মহাকাল, বীরভদ্র প্রমুখ রয়েছে।
অঘোরিদের গমনাগমন মূলত ভারতের শাক্ত তীর্থগুলোতে। তবে বিশেষ কয়েকটি মন্দির বা দেবস্থানকে তারা তাদের উপাসনাক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্ব দেয়। জন্মচক্র থেকে মুক্তি এবং মোক্ষের সাধনাই অঘোরিদের কাছে মুখ্য কাজ। তাদের ক্রিয়া-কর্ম রাত্রিকালীন। তারা এমনিতেও নিশাচর। কিন্তু তাই বলে তারা ‘অপ্রকাশ্য’ নন।
ইতিহাসবিদদের মতে, আলেকজান্ডার এবং তার সৈন্যরাও নাগা সাধুদের মুখোমুখি হয়েছিল। বুদ্ধ এবং মহাবীর নাগাদের তপস্যা, মানুষ এবং মাতৃভূমির প্রতি নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। জানা যায়, ভারতে যখন বকধার্মিকদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিল তখন গুরু শংকরাচার্য তাদের রুখতে একটি খারু গঠন করেন। এই সঙ্ঘের মাধ্যমেই নাগা সাধুদের বর্তমান ধারার উৎপত্তি ঘটে। নাগারা বরাবরই শাস্ত্রজ্ঞান ও অস্ত্রজ্ঞান উভয় বিষয়েই সমান দক্ষ ছিল।
একসময় তারা এ দুটির সমন্বয়ে সনাতন ধর্ম রক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিল। জানা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রচলিত হওয়ার পর বিভিন্ন সময় নাগা সাধুরা স্ব-ধর্ম রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে তারা অনেক আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এর মধ্যে ১৭৬০ এর দশকে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে তাদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। অনেক জমিদারের পক্ষ নিয়েও তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
অঘোরিদের সংখ্যা খুবই কম। ধারণা করা হয় এই সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি হবে না। পূণ্যার্থীরা তাদের খাবার এবং অর্থকড়ি দেয়। কিন্তু অঘোরিরা অর্থকড়ির ব্যাপারে নিস্পৃহ। এরা কিন্তু সবার জন্যই প্রার্থনা করে। কেউ সন্তান পাওয়ার জন্য তাদের আশীর্বাদ চাইছে আর কে বাড়ি বানানোর জন্য, সেটা নিয়ে তারা ভাবে না।
অঘোরী সাধুরা মৃতদেহ ভক্ষণ, মূত্রপান ইত্যাদি অভ্যাস করে। ১৭ শতকের সন্ন্যাসী বাবা কিনারামের সূত্রেই এই আচারণগুলো অঘোরিদের কাছে প্রবেশ করেছে বলে জানা যায়। এর বাইরে অঘোরিরা নিয়মিত শবসাধনা করে থাকে। মৃতদেহ থেকে হাড় ছাড়িয়ে তা নিজেদের শরীরে ধারণ করে, সঙ্গে রাখে। মানুষের হাড়কে তারা গহনার মতো পরিধান করে। এছাড়াও তারা মৃতদেহ থেকে অসাধারণ তেল বের করে ওষুধ তৈরি করে,যা খুব কার্যকর বলে কিছু মানুষ মনে করে থাকে।
অনেক অঘোরি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে যে তারা মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গম করেছে। তবে তাদের সমাজেও যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু নিষেধের বেড়াজাল আছে। এরা পতিতাদের সঙ্গে তাদের রীতি অনুযায়ী যৌনসঙ্গম করে। তবে তাদের ইচ্ছা না থাকলে স্পর্শ করে না। এরা সমকামিতায় বিশ্বাসী নয়, এটি অনুমোদনও করে না। যখন অঘোরিরা মারা যায়, তাদের দেহ অন্য অঘোরিরা খায় না। তাদেরকে কবর দেয়া হয় কিংবা চিতায় পোড়ানো হয়।
অনেক অঘোরি প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে যে তারা মৃতদেহের সঙ্গে সঙ্গম করেছে। তবে তাদের সমাজেও যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু নিষেধের বেড়াজাল আছে। এরা পতিতাদের সঙ্গে তাদের রীতি অনুযায়ী যৌনসঙ্গম করে। তবে তাদের ইচ্ছা না থাকলে স্পর্শ করে না। এরা সমকামিতায় বিশ্বাসী নয়, এটি অনুমোদনও করে না। যখন অঘোরিরা মারা যায়, তাদের দেহ অন্য অঘোরিরা খায় না। তাদেরকে কবর দেয়া হয় কিংবা চিতায় পোড়ানো হয়।
অঘোরিদের মতে, মা কালী যৌনাচারে খুশি হন। তাই তারা খোঁজ করতে থাকে উপযুক্ত একটি মৃতদেহের। সমাধি থেকে সদ্য তাজা লাশ উঠিয়ে এনে তার সঙ্গে শুরু করে অবাধ ও বিকৃত যৌনাচার। বারানসীর অঘোরি মেরোনাথ এক সাক্ষাৎকারে ফটোগ্রাফার এবং লেখক ডাভোর রস্তুহারকে বলেন, “আমরা যা করি, তা বাইরের বিশ্বের কাছে শুনতে পাগলামী মনে হলেও আমাদের কাছে খুবই নৈমিত্তিক একটি ব্যাপার। নোংরার মাঝে শুদ্ধতা খুঁজে পাওয়া, এটিই আমাদের মূলমন্ত্র। মৃতদেহের সঙ্গে যৌনাচার কিংবা মৃতদেহ ভক্ষণ করার পাশাপাশি একজন অঘোরি যদি ঈশ্বরকে খুঁজে পায়, তাহলে বুঝতে হবে সে সঠিক পথেই আছে।”
অঘোরিদের কাছে ক্যানিবালিজম বা মানুষের মাংস খাওয়া স্বাভাবিক একটি বিষয়। তাই বলে ভাববেন না যে তারা জীবিতের মাংস খায়। মানুষ মরে যাবার পর তাদেরকে সমাধিস্থ করা হয়। তখন কবর খুঁড়ে দেহ তুলে এনে সেগুলো ভক্ষণ করে অঘোরিরা। মাঝে মাঝে সেগুলো আগুনে ঝলসিয়েও খাওয়া হয়। পর্যাপ্ত মাংস খেয়ে নেবার পর বাকি মৃতদেহের ওপর তারা বসে পূজা শুরু করে, চলে সারারাত। তবে কিছু কিছু অঘোরি রয়েছে যারা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। তারা জীবিত মানুষের ওপর হামলা করে মাংস খাওয়া শুরু করে। তাই অঘোরিদের এই ধরনের ক্রিয়াকলাপের জন্য বারানসীর মানুষ অনেক বেশি সতর্ক আচরণ করে। সমাধিস্থলেও বাড়ানো হয়েছে সতর্কতা।
চাইলেই যে কেউ অঘোরি হতে পারবেন না। টানা ১২ বছর কঠোর সাধনার পর অঘোরি গুরুর আশীর্বাদে নিজের ধর্মীয় যাত্রা শুরু করেন অঘোরি সাধুরা। সন্ন্যাসী হয়ে ওঠার আগে, তাদের নিজের শ্রাদ্ধ তথা তর্পন নিজেকেই করতে হয়। ছিন্ন করা হয় সাংসারিক সম্পর্ক চিরতরে। শুরু হয় ‘সন্ন্যাস জীবন’; যেন ঠিক পুনর্জন্মের মাধ্যমেই শুরু করা হলো, একটি নতুন জীবন।
অঘোরিরা নিজেদের দেহে ছাই মাখে। তবে তাদের শরীরে মাখা ছাইও একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি বলে জানা যায়। যজ্ঞের ভস্মের সঙ্গে গোবর, কলাপাতা, বেলপাতা, কাঁচা দুধ, কলা এবং ঘি দিয়ে এই মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এই ভস্ম গায়ে মাখলে বিষাক্ত পোকামাকড়, সাপ, মশা কিছু কাছে আসে না বলে জানা যায়। পাহাড় কিংবা আশেপাশের অঞ্চলেই থাকে এরা সব সময়।
তবে গত কয়েক দশকে সমাজের মূলধারার অনেক কিছু অঘোরিরা তাদের সমাজে চালু করেছে। যেমন তারা কুষ্ঠরোগীদের জন্যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার সাংস্কৃতিক নৃতাত্ত্বিক রন ব্যারেট জানালেন, সমাজের সবচেয়ে অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত কুষ্ঠরোগীদের সঙ্গে তারা কাজ করছে। বেনারসে অঘোরিরা কুষ্ঠরোগীদের জন্য ক্লিনিক চালায়। সেখানে তাদের আয়ুর্বেদী চিকিৎসা দেয়।
অঘোরিদের অনেকে এখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। বাসে-ট্রেনেও চড়ে। আর জনসমক্ষে আসার সময় তারা অন্তত কিছু কাপড় পরে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১০০
আপনার মতামত জানানঃ