ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের চার দিনে গড়ে প্রতি ঘন্টায় ১২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কেবল চলতি মাসের ৪ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ১৪৫ জন আর মারা গেছেন পাঁচ জন। এদিকে রোগী ভর্তির অক্ষমতা, মেডিসিনের সল্পতার মত প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তৈরী হয়েছে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ২৬৫ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় ২৩২ জন এবং বাইরে ৩৩ জন। আগের দিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ২৫৫ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ২৩৩ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৩ জন। চলতি মাসের চার দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
দেশে চলতি বছরের শুরু থেকে ৪ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৫০১ জন আর মারা গেছেন ৫১ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১০ হাজার ১৭৪ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে মোট ৫১ জনের। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছে ১ হাজার ২৭৩ জন। ঢাকার ৪১টি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১ হাজার ১৩৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ভর্তি আছেন ১৩৬ জন।
করোনা মহামারির মধ্যে ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ ধারণ করায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৩ আগস্ট ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় ছয়টি হাসপাতালকে ডেডিকেটেড ঘোষণা করে। হাসপাতালগুলো হলো—স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতাল ও গাজীপুরের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল।
তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সক্ষমতা যাচাই না করেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ঘোষণা দিয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য অবকাঠামো না থাকায় চিকিৎসা শুরু করতে পারছে না কোনও কোনও হাসপাতাল। কোনও হাসপাতাল সীমিত সম্পদের ব্যবহার করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. সাইদুন নাহার হাসপাতালের সীমিত সম্পদের কথা স্বীকার করে বলেন, সীমিত সম্পদ নিয়ে ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি চিকিৎসা দেওয়ার। তবে সংকট কিছুটা রয়েছে—এটা মানতেই হবে।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য এ হাসপাতাল এখনও প্রস্তুত নয় জানিয়ে লালকুঠি জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. শামছুল করিম বলেন, জনবল এখনও আসেনি। আউটডোর চালাচ্ছি কেবল ফিভার ক্লিনিক দিয়ে কিন্তু ইনডোর না।
রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না, মেডিসিন নেই, নার্স নেই, রেডিওলজিস্ট নেই-টেকনোলজিস্ট নাই জানিয়ে তিনি বলেন, আমার ডাক্তার-নার্স-টেকনোলজিস্ট দরকার, এটা জানিয়েছি কিন্তু এখনও আসেনি।
মেডিসিন কনসালটেন্ট পাঁচ জন, মেডিক্যাল অফিসার ২০ জন, নার্স ২০ জন, টেকনোলজিস্ট চারজনসহ ডেঙ্গু টেস্ট করার জন্য রি-এজেন্টের চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে বলেও জানান ডা. শামছুল করিম।
এদিকে, রেলওয়ে বিভাগের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষায়িত হাসপাতাল রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালকেও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল এখনও অফিসিয়াল অর্ডারই পায়নি। সেইসঙ্গে নেই হাসপাতালের জনবল। নেই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। প্যাথলজিস্ট আছেন একজন। তার একার পক্ষে ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালের কার্যক্রম চালানো সম্ভব নয়। ইনডোরে মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন মাত্র একজন, নার্স রয়েছেন মাত্র নয়জন। অথচ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ইমার্জেন্সি কিছু টেস্ট করা দরকার হয় যখন তখন, বলছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে এই হাসপাতালে কোনও পোস্টই নেই জানিয়ে হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. রিপন দাস এক জাতীয় দৈনিককে বলেন, অন্তত দুজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, আরও একজন প্যাথলজিস্ট, আরও একজন ল্যাব টেকনিশিয়ান, চার জন মেডিক্যাল অফিসার এবং আরও অন্তত ১০ জন নার্স দরকার।
সক্ষমতা যাচাই না করে, প্রস্তুতি না নিয়ে হঠাৎ করেই হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা করা হলো কেন—এমন প্রশ্নে স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ- ই- মাহবুব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরে যারা রয়েছেন তাদের কথার সঙ্গে বাস্তবতার কোনও মিল নেই।
প্রস্তুত না করেই হাসপাতালগুলোকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড কেন করা হলো জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা ঐ জাতীয় দৈনিককে বলেন, আমাদের একটা জুম মিটিংয়ে এরকম একটা সিদ্ধান্ত ছিল। সে অনুযায়ী ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল। তবে এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করার জন্য।
তবে ডেডিকেটেড ঘোষণা করা রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল রেলপথ মন্ত্রণালয়ের আর লালকুঠি জেনারেল হাসপাতাল পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে জানিয়ে তিনি বলেন, এসব হাসপাতালে জনবলসহ অন্যান্য সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি।
এদিকে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ছয়টি ডেডিকেটেড হাসপাতাল তৈরি করা হলেও চারটি এখনো অকার্যকর।
কীটতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, চলতি মাসের ১৫ দিন পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। এ সময়ে মশক নিধন কার্যক্রম এবং এডিস মশার লার্ভা নিধন কার্যক্রমকে জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গুর এমন করুণ পরিস্থিতিতে হাসপাতালের অক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে রোগীদের ভোগান্তি। মশা নিধনের পাশাপাশি হাসপাতালের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি না করলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দেয়া আরও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে।
এসডব্লিউ/ডব্লিউজেএ/২২১৫
আপনার মতামত জানানঃ