আবারও বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে রক্ত ঝরলো এক বাংলাদেশির। কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে শহিবুর রহমান (৩৪) নামে এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। আজ শনিবার (০৪ সেপ্টেম্বর) ভোরে উপজেলার দাঁতভাঙা ইউনিয়নের কাউনিয়ারচর এলাকার আন্তর্জাতিক পিলার ১০৫৪ এর কাছে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শহিবুর রহমান উপজেলার দাঁতভাঙা ইউনিয়নের আমবাড়ি গ্রামের মৃত এরাজ আলীর ছেলে। গতবাল শুক্রবার দিবাগত রাতে শহিবুরসহ কয়েকজনের একটি দল সীমান্তে গরু চোরাচালানের উদ্দেশ্যে যায়। এ সময় ভারতের দ্বীপচর ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা বাংলাদেশি ওই দলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। এতে বুকের বাঁ পাশে গুলিবিদ্ধ হন শহিবুর। সঙ্গে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার পথে মারা যান তিনি। শনিবার সকালে পুলিশ শহিবুরের বাড়ি থেকে মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।
জামালপুর বিজিবি ৩৫ ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের হাবিলদার সহকারী মুকিব জানান, সীমান্তে গুলির শব্দ শুনে একটি টহল দল নৌকা নিয়ে যায়। এ সময় কাউকে দেখতে পায়নি তারা। পরে স্থানীয়দের কাছে শহিবুরের গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার খবর পুলিশকে জানানো হয়। গুলির শব্দ শুনতে পেলেও বিষয়টি বিএসএফের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রৌমারী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোন্তাছের বিল্লাহ বলেন, নিহতের পরিবারের দাবি, তারা সীমান্ত এলাকায় মাছ ধরতে গিয়েছিল। এ সময় বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। বিজিবি ও স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে লালমনিরহাট বুড়িমারী মাইয়ামরাঘাট সীমান্তে ভারতীয় চেংরাবান্ধা বিএসএফ’র গুলিতে দুই বাংলাদেশি নিহত হন। গত ২৯ আগস্ট ভোরে এ ঘটনা ঘটে।
বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সেদিন ভোর রাতে বুড়িমারী সীমান্তের ৮৪৩ মেইন পিলার দিয়ে ভারতের চেংরাবান্ধায় চোরাইভাবে গরু আনতে যান ইউনুস ও সাগর চন্দ্র। এ সময় ভারতীয় চেংরাবান্ধা বিএসএফ সদস্যরা তাদের লক্ষ করে গুলি করে।
তথ্য মতে, ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে সীমান্তে গুলিতে নিহত হয়েছে ৪২ জন বাংলাদেশি। আর নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ৬ জন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কে উন্নতি ঘটলেও তার প্রতিফলন দেখা যায়নি দুই দেশের সীমান্তে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা হলেও তাতে সীমান্ত পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি। এমনকি সীমান্তে প্রানঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার ব্যাপারে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ঐক্যমত্য থাকলেও তা প্রায়ই লঙ্ঘন হতে দেখা যায়।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘সীমান্তের হত্যা কমবে না, সংখ্যাটাও নিচে নামবে না। কারণ, ভারতের বিএসএফকে আমি সবসময় ট্রিগার হাতেই দেখি। তারা গুলি করার জন্য প্রস্তুত থাকে। আগে গুলি করে, পরে কথা বলে।’
তিনি বলেন, ‘বিএসএফের বেশিরভাগ সদস্যই অবাঙালি। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তারা এখনো মনে করে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষুধার্ত, বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। তাই তারা ভারতে যায়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ। বিষয়টি ভারতের পলিটিক্যাল লেভেল (রাজনৈতিকভাবে) থেকে বিএসএফকে সেভাবে বার্তা দেওয়া হয় না অথবা বিএসএফ তাদের কথা শোনে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার মতে, যদি ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়, তাহলে তাদের নিচের লেভেলে (বিএসএফ) অ্যাকশন নিতে হবে। তবে এ ধরনের অ্যাকশন তারা আগে কখনো নেয়নি। এমনকি ফেলানীর ঘটনায়ও কিছু হয়নি। পলিটিক্যাল লেভেল থেকে শক্ত বার্তা না দিলে সীমান্তে হত্যার কোনো সুরাহা হবে না। এ হত্যাকাণ্ড বাড়তে থাকলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিদ্বেষী মনোভাব আরও প্রকট হবে’।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর আবু আহমেদ ফয়জুল কবির অনলাইনভিত্তিক এক দৈনিককে বলেন, ‘বিএসএফ দ্বারা হত্যার পর কোনো বাংলাদেশির কাছে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া গেছে— এমন কোনো নজির বা ঘটনা নেই। যারা মারা যান, তাদের শতভাগই নিরীহ (ইনোসেন্ট)। যেহেতু বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে কোনো অস্ত্র থাকে না সেক্ষেত্রে বিএসএফ সদস্যরা তাদের আটক করে পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা নির্যাতন ও গুলি চাই না। এমনকি সীমান্তে ভারতের অনুপ্রবেশকারী নাগরিক থাকলে বিজিবি তাদের আটক করে ফিরিয়ে দেয়, হত্যার নজির নেই। অথচ আগ্নেয়াস্ত্র না থাকা সত্ত্বেও বিএসএফ বাংলাদেশিদের হত্যা করছে। বিএসএফের উচিত বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্কের কথা বিবেচনায় নিয়ে নমনীয় আচরণ করা।’
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৯৪২
আপনার মতামত জানানঃ