স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া মসজিদ, মন্দির, গির্জাসহ সব ধরনের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও শ্মশান নির্মাণ করা যাবে না— এমন বিধান রেখে একটি নীতিমালা করার প্রস্তাব তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। তাতে বলা হয়েছে, ব্যক্তি উদ্যোগে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কবরস্থান-শ্মশান তৈরিতেও সরকারের অনুমতি নিতে হবে এবং উদ্যোক্তার আয়ের উৎসও জানাতে হবে। তবে সংসদীয় কমিটির এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসান এবং শীর্ষ আলেমরা।
অনুমোদন ছাড়া ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ নয়
ব্যক্তিগত উদ্যোগে ধর্মীয় স্থাপনা ও কবরস্থান বা শ্মশান তৈরি করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। এসব স্থাপনা নির্মাণে উদ্যোক্তার আয়ের উৎসও জানাতে হবে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশে এমন বিধান করে একটি নীতিমালা তৈরি করতে যাচ্ছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
রোববার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে নীতিমালা তৈরি করতে ৯ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে।
এতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে ধর্মীয় স্থাপনা, কবরস্থান/শ্মশান স্থাপন না করা, এসব স্থাপনা তৈরিতে সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমতি গ্রহণ, খাসজমিতে এসব স্থাপনা তৈরি না করা এবং প্রস্তাবিত ইউনিয়ন পরিষদের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মীয় স্থাপনা ও বাড়িঘর নির্মাণে ইউনিয়ন পরিষদকে জানানোসহ কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির আগের বৈঠকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং কবরস্থান/শ্মশান স্থাপনে সরকারের অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যবাধকতা এবং ইউনিয়ন পরিষদের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বাড়িঘর নির্মাণে ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করার সুপারিশ করা হয়।
সংসদীয় কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিয়ন পর্যায়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘর তৈরি করতে হলে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদকে অবহিত করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে দেশের সব জেলা প্রশাসককে ইতোমধ্যে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
সংসদীয় কমিটির সূত্র জানায়, গত ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংসদীয় কমিটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ এবং কবরস্থান ও শ্মশান স্থাপনের বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চেয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি কমিটি গঠন করে। ১৯ আগস্ট কমিটি তাদের ৯ দফা প্রস্তাব দাখিল করে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ইউনিয়ন পর্যায়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি উপজেলা কমিটি, পৌরসভায় পৌর কমিটি এবং সিটি করপোরেশনে ওয়ার্ড কমিটি থাকবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও শ্মশান নির্মাণ করতে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলের কাছে আবেদন করতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পাকা বা স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করতে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীর তৈরি করা প্ল্যান ও ডিজাইন আবেদনের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ আবেদন যৌক্তিক মনে করলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন। ওই আবেদন উপজেলা সমন্বয় সভায় অনুমোদন দেওয়া হবে। পৌর এলাকায় জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি এবং সিটি করপোরেশনে মেয়রের সভাপতিত্বে মাসিক সাধারণ সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া সরকারি বা খাসজমিতে এবং পরিত্যক্ত বা অর্পিত সম্পত্তিতে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, অন্যান্য স্থাপনা, কবরস্থান ও শ্মশান নির্মাণ করা যাবে না। অনুমোদন ছাড়া এ ধরনের স্থাপনা করা হলে তা উচ্ছেদ করার পাশাপাশি নির্মাতাকে জবরদখলকারী হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। ভবিষ্যতে রাস্তা প্রশস্তকরণের বিষয়টি বিবেচনা করে এ ধরনের স্থাপনা রাস্তা থেকে যৌক্তিক দূরত্বে নির্মাণ করতে হবে।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও শ্মশান নির্মাণের জন্য কোনো জমি ওয়াকফ, দান, কেনা বা আইন অনুযায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে বরাদ্দ পেলে সেখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কবরস্থান বা শ্মশান নির্মাণ করা যাবে। তবে আদালতে মামলা চলমান থাকলে নির্মাণ করা যাবে না। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব জমিতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও কবরস্থান নির্মাণ করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে কমপক্ষে দুই কিলোমিটার বা যৌক্তিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ঈদগাহ উন্মুক্ত স্থানে থাকবে। বছরের অন্য সময়ে ঈদগাহগুলোতে ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে ব্যবহারের সুযোগ রাখতে হবে।
প্রতিযোগিতামূলকভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও শ্মশান স্থাপন করা যাবে না। এলাকার জনসংখ্যা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ও শ্মশান নির্মাণ করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আয়ের উৎস জানাতে হবে এবং তিনি আয়কর দেন কি না, তা বিবেচনায় আনতে হবে।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, আসলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়। ইউনিয়ন পর্যায়েও যেকোনো স্থাপনা যেমন বসতবাড়ি, দোকান— যাতে অপরিকল্পিতভাবে না হয়, সেটি তারা একটি নীতিমালার মধ্যে আনতে চান। এখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কোনো বিষয় নেই।
মানতে চাইছেন না আলেমরা
মসজিদ, মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের সুযোগ শর্তমুক্ত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন কওমি মাদরাসা ভিত্তিক শিক্ষাবোর্ড আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের চেয়ারম্যান আল্লামা মাহমুদুল হাসানসহ দেশের শীর্ষ আলেমরা।
আজ সোমবার (৩০ আগষ্ট) সোমবার আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের কার্যালয়ে আল্লামা মাহমুদুল হাসানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির সভায় সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়।
আল-হাইআতুল উলয়ার নেতৃবৃন্দ বলেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত প্রস্তাবটি নতুন মসজিদ-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পথ চরমভাবে সংকুচিত করবে। এতে পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানগণ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রস্তাবটি মুসলিমসহ সব ধর্মানুসারীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, যা রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটাতে পারে।
আল-হাইআতুল উলয়ার নেতৃবৃন্দ মনে করেন, প্রস্তাবটি কুরআন, হাদীস, দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতি এবং ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ আইন, ২০১৮ (২০১৮ সনের ৪৮ নং আইন)-এর পরিপন্থী।
তারা বলেন, কওমি মাদরাসাগুলো বন্ধ থাকার কারণে বহু এতিম-গরিব ছাত্র অনাহারে কষ্ট পাচ্ছে। বহু ছাত্র ঝড়ে যাচ্ছে। হেফজখানা ও মক্তবের ছাত্রদের কুরআন তেলাওয়াত, শেষরাতের রোনাজারি, জিকির ও দোয়া সব বন্ধ। সভায় সরকারের কাছে কওমি মাদরাসা অতি দ্রুত খুলে দিয়ে ছাত্রদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে বাঁচানোর অনুরোধ জানানো হয়।
সভায় গ্রেপ্তারকৃত আলেম-উলামা ও মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের অবিলম্বে মুক্তিদানেরও জোর দাবি জানানো হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৯
আপনার মতামত জানানঃ