যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে স্থাপনা ও এলাকার মুসলিম নাম বদলে হিন্দু নাম রাখার ধুম পড়েছে। মুঘলসরাই, এলাহাবাদের পর ‘মিঞাগঞ্জ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘মায়াগঞ্জ’ রাখার দাবি তোলা হয়েছে সম্প্রতি। তারও আগে মির্জাপুরের নাম বদলে ‘বিন্ধ্য ধাম’ করার দাবি উঠেছে। বিজেপিশাসিত উত্তরপ্রদেশে স্থাপনা ও এলাকার মুসলিম নাম বদলে ফেলার ধারাবাহিকতায় এবার ঐতিহ্যবাহী জেলা সুলতানপুরের নাম পরিবর্তন করতে চলেছে সেখানকার সরকার। হিন্দুত্ববাদী কতিপয় মৌলবাদী সংগঠনের দাবির অজুহাত দেখিয়ে জেলার নাম রামের পুত্র কুশের নামে অর্থাৎ কুশভবানপুর রাখার আলোচনা চালাচ্ছে যোগী আদিত্যনাথের সরকার।
ভারতীয় গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, এই দাবি আজকের নয়। ২০১৮ সালে উত্তরপ্রদেশের বিধায়ক দেবমণি দ্বিবেদী এই প্রস্তাব রেখেছিলেন। পরে সুলতানপুরের জেলাশাসক ও অযোধ্যার ডিভিশনাল কমিশনারও রাজ্য সরকারের কাছে এই প্রস্তাব রেখেছিলেন। এমনকী, ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল রাম নায়েক মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে চিঠি লিখে ওই পরিবর্তনের আরজি জানান।
উত্তরপ্রদেশের রাজস্ব দপ্তরের এক আধিকারিক ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সুলতানপুরের নাম বদল করার প্রস্তাব ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। এই বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন সুলতানপুরের লামভুয়ার বিজেপি বিধায়ক দেবমণি দ্বিবেদী। তিনি এর আগে এই বিষয়টি বিধানসভাতেও উত্থাপন করেছিলেন।
বিজেপি বিধায়কের প্রস্তাবের পর সুলতানপুরের জেলাশাসক এবং অযোধ্যার ডিভিশনাল কমিশনার রাজ্য সরকারের রাজস্ব দপ্তরের কাছে সুলতানপুরের নাম বদলে কুশভবানপুর করার প্রস্তাব পাঠান। প্রস্তাবের সঙ্গে তিনি গেজেট থেকে সুলতানপুরের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্যও পাঠিয়েছেন।
এই মুহূর্তে সেই প্রস্তাব নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। যদি শেষ পর্যন্ত তা স্বীকৃতি পায়, তাহলে এই নিয়ে নাম পরিবর্তিত হবে উত্তরপ্রদেশের তৃতীয় জেলার। এর আগে ফৈজাবাদের নাম বদলে অযোধ্যা ও এলাহাবাদের নাম বদলে প্রয়াগরাজ করা হয়েছিল। এবার সেই পথে হাঁটতে চলেছে সুলতানপুরও।
এদিকে বৃহস্পতিবারই শোনা গিয়েছিল উন্নাও গ্রাম পঞ্চায়েতের দাবি, মিঞাগঞ্জের নাম অবিলম্বে পরিবর্তন করা হোক। আর তার বদলে নতুন নাম হোক মায়াগঞ্জ। উন্নাওয়ের জেলাশাসক রবীন্দ্র কুমার জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে তার কাছে নাম বদলের সুপারিশ এসেছে। গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে ‘মিঞাগঞ্জ’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘মায়াগঞ্জ’ রাখার দাবি তোলা হয়েছে। পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য তিনি তা রাজ্য সরকারের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গত মাসেই নাম বদলের জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে চিঠি লিখেছিলেন স্থানীয় বিধায়ক বাম্বা লাল দিবাকর। তারপরই গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপ করা হয়।
তিনি আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। যোগীর রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তার কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা।
শুধু মিঞাগঞ্জ নয়, উত্তরপ্রদেশের আরেক জনপ্রিয় এলাকা মির্জাপুরের নাম বদলে ‘বিন্ধ্য ধাম’ করার দাবিও উঠেছে। রাজ্যের মন্ত্রী রামশংকর সিং প্যাটেল এমনই দাবি তুলেছেন।
একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেছেন, ফৈজাবাদের নাম পরিবর্তন করে যেমন অযোধ্যা রাখা হয়েছে, তেমনই মির্জাপুরের নামও বদল করা উচিত। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলেও দাবি করেছেন তিনি। এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভাবাবেগ জড়িয়ে থাকার কথা বলেছেন উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঐতিহাসিক দলিল বা তথ্যকে উপেক্ষা করে যখন কেউ বা কারা ইতিহাস নিয়ে বুলি আওড়ান, তখন তাদের ‘বোধহীন’ অথবা ‘বিকৃতমনষ্ক’ বলে দাবি করতে হয়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বোধহীন নন। তিনি একজন রাজনীতিবিদ। অতীতে রাজনীতির ময়দানে তিনি বহু বিতর্কিত ঘটনা ঘটিয়েছেন। বহুবার বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন এবং সেই বিতর্ক সামলেও নিয়েছেন। তিনি জানেন, রাজনীতির ময়দানে কীভাবে কোন দিকে বল বাড়িয়ে গোল করতে হয়।
তারা বলেন, তার রাজনীতি, রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে কারো দ্বিমত থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বিভিন্ন মতামত, বিভিন্ন কণ্ঠ থাকবে, সেই তো স্বাভাবিক। তিনি বা তার দল ইতিহাস নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। সেই মত অনেকের সঙ্গে না-ই মিলতে পারে। কিন্তু তার ইতিহাসের ব্যাখ্যা যখন তথ্যবিকৃত হয়ে যায়, তখন তাকে প্রশ্ন করার, কাঠগড়ায় তোলার যথেষ্ট কারণ থাকে। আঙুল তুলে তাকে প্রশ্ন করতেই হয়, কেন এই মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন?
বিশ্লেষকরা বলেন, বলতে দ্বিধা নেই, যোগী আদিত্যনাথের ইতিহাসের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। তা নিয়ে তিনি যে আজগুবি কথা বলছেন, তার পিছনে আবার একটি মস্ত চক্রান্ত রয়েছে। গৈরিক ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন ব্যাখ্যার আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হলে তর্ক করতে অসুবিধা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কিন্তু যোগী যে ইতিহাস বলছেন, তা বিতর্কেরও অযোগ্য। ভাবতে অবাক লাগে, তার পারিষদগণ, তার আধিকারিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে ভুল ধরিয়ে দিতে পারেন না বা ভয় পান।
তারা বলেন, তিনি আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। যোগীর রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তার কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা। এটা কট্টর মানসিকতাকে তুষ্ট করবে, তার প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে নজর অন্যদিকে ঘোরাবে। হয়তো বা ভোট পেতেও ঢালাও সাহায্য করবে। তবে বলে রাখা ভালো, এক বা একাধিক ব্যক্তি শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস বদলাবে না। ঐতিহাসিক দলিল আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ