মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা এখন আর নির্ধারিত ক্যাম্পে সীমাবদ্ধ থাকছে না। তারা স্থানীয় প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানা কৌশলে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কেউ দালালের মাধ্যমে, কেউ ক্যাম্পের বাইরে অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে, কেউ গাড়ি চালকদের মাধ্যমে সড়ক বা নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে।
এদিকে কক্সবাজারের টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা ৭৪ রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে আটক করা হয়েছে। আটকরা সবাই পুরুষ। তারা সবাই রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এসে সেখানে বসবাস করছিল।
মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে উপজেলার আহল্লা করলডেঙ্গা ইউনিয়ন এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়।
পুলিশ জানায়, আটককৃত রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বোয়ালখালীতে চলে আসে। তারা লেবু বাগানসহ এলাকায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিল। আটককৃতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।
বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল করিম বলেন, টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এই রোহিঙ্গারা বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা এলাকার একটি লেবু বাগানে কাজ নেয়। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে খবর পেয়ে তাদের আটক করে পুলিশ।
বোয়ালখালী থানার ওসি বলেন, এই রোহিঙ্গারা কীভাবে পালিয়েছে, কেউ তাদের পালাতে সাহায্য করেছে কি না, কে তাদের কাজ দিয়েছে, এ বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
ওসি বলেন, আটককৃতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর আদালতে সোপর্দ করা হবে। স্থানীয়দের মধ্যে যারা তাদেরকে আশ্রয় দিচ্ছেন তাদের ব্যপারেও খতিয়ে দেখা হবে। আটক রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে ৩৬টি মুঠোফোন জব্দ করা হয়।
টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের পালানোর ঘটনা আগেও একাধিকবার ঘটেছে।
প্রাপ্ত সুত্রমতে জানা যায়, গত জুলাই মাসের ৭.১২.১৯.২৫.২৬.২৮ তারিখ বুধবার পর্যম্ত পর্যায়ক্রমে ০৫.০৪.১৯.৭৮.১৩৯.১৯.২৫ সর্বমোট ২৮৯ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আটক করা হয়। সর্বশেষ আগস্ট মাসের ৩ ও ৪ পর্যন্ত সর্বমোট ৩৭০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে উপজেলার বিভিন্ন স্থান হতে আটক করা হয়। তাছাড়া ৩৭০ জনের মধ্যে ৮০% রোহিঙ্গা জোয়ারিয়ানালা ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থান হতে আটক করা হয়।
সুত্র মতে, রামু উপজেলা ও ঈদগাঁও উপজেলার কতিপয় দালাল মিডিয়া হিসাবে কাজ করে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে নিয়োগ করে থাকে। তারা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন সময় এই রোহিঙ্গাদের নানা অপকর্মে লিপ্ত করারও অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রায় চার বছর সময় অতিবাহিত হওয়ায় ভাষা, আচার-আচরণের ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা নিজেদের স্থানীয়দের মতো করে তৈরি করে নিচ্ছে। আর এই বিষয়টিকেই পুঁজি করে তারা ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছে। প্রশাসনের কাছে তাদের দাবি, রোহিঙ্গারা যেন কোনোভাবেই স্থানীয়দের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গারা যাতে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সে জন্য টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট। পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব চেকপোস্টে তল্লাশি চালান। রোহিঙ্গাদের অবাধ যাতায়াত রোধ করতে স্থানীয়দের যাতায়াতের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে চলাচল করতে হয়। এত সতর্কতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে। জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক ও অসামাজিক পেশায়।
রোহিঙ্গারা যাতে দেশের মূল জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সে জন্য টেকনাফ থেকে উখিয়া পর্যন্ত বসানো হয়েছে বেশ কয়েকটি চেকপোস্ট। পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এসব চেকপোস্টে তল্লাশি চালান। রোহিঙ্গাদের অবাধ যাতায়াত রোধ করতে স্থানীয়দের যাতায়াতের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে চলাচল করতে হয়। এত সতর্কতা সত্ত্বেও রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে। জড়িয়ে পড়ছে সামাজিক ও অসামাজিক পেশায়।
বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সীমানা প্রাচীর দিতে হবে। নইলে তারা অচিরেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে নাগরিকত্ব সনদও গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় সরকারের পক্ষ থেকে হোটেল, রাস্তা, যানবাহনে সার্বক্ষণিক নজরদারি ও তল্লাশির ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা অনেকটাই শিথিল।
তারা বলেন, রোহিঙ্গাদের মত কিছু স্থানীয় ব্যক্তিরা পরিস্থিতির জন্য অনেকটা দায়ী। কারণ কম মজুরিতে পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের অনেকে নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গৃহস্থালী এবং কৃষি ক্ষেত্রে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দেয়। তাই অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সকল সুবিধা পাওয়ার পরও লোভের বশবর্তী হয়ে কাজের আশায় দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। তাই যারা রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ বা আশ্রয় দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরায় আতঙ্কে স্থানীয়রা
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে থাকা কিছু রোহিঙ্গা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অপহরণ, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি ও খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। এতে নিরীহ রোহিঙ্গাসহ স্থানীয়রা রয়েছেন আতঙ্কে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা। দিন যতই যাচ্ছে ততই ক্যাম্পে থাকা অনেক রোহিঙ্গা জড়িয়ে পড়ছে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো ক্যাম্পে ঘটছে নিজেদের মধ্যে মারামারি। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসাসহ জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এতে ক্ষুব্ধ খোদ ক্যাম্পের নিরীহ রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গারা অবাধে চলাফেরাসহ স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের ওপর তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হলে স্থানীয় লোকদের খুন করেছে এমন ঘটনাও ঘটেছে।
অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত থাকলেও রোহিঙ্গারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে যায়। এমনকি রাতের বেলায়ও রোহিঙ্গারা গ্রামে গ্রামে দেশীয় অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাচল করে বলে স্থানীয়রা জানায়।
জানা গেছে, হোয়াইক্যং ইউপির মিনাবাজার এলাকার দুই ভাইকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে মাটিতে পুঁতে রেখেছিল। ৩ মে ২০২০ সালে পুলিশ আকতারুল্লাহ নামে একজনের লাশ উদ্ধার করেছে। এভাবে রোহিঙ্গাদের হাতে প্রায় অর্ধশতাধিক স্থানীয় বাসিন্দা মারা গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ টেকনাফ বাহাড়ছড়া ইউনিয়নের অটোরিকশা চালক মাহমুদুল করিমকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেছিল তারা। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রায় দেড় মাস পরে তাকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী মানুষের যোগসাজশে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা হত্যাকাণ্ড চালাতে সাহস পাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অবাধে চলাফেরা বন্ধ করতে হবে, তবেই এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যা-নির্যাতন শুরু হলে প্রাণে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১৪ লাখ রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গাদের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩৭
আপনার মতামত জানানঃ