২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম হারিয়েছে তাদের খুঁটির জোর। ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টির পাশাপাশি একটি গোষ্ঠীর কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া সংগঠনটি নড়বড়ে নেতৃত্ব আর সরকারের রোষানলে এখন খাদের কিনারে। এছাড়া মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে তিন শীর্ষ নেতাকে হারিয়ে বিশৃঙ্খলার চূড়ান্ত সীমায় অবস্থান করছে হেফাজতে ইসলাম।
সম্প্রতি সংগঠনটির নেতৃত্বে এসেছেন একসময়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। তবে আল্লামা শফীর পর জুনায়েদ বাবুনগরীর নেতৃত্ব যেমন সংগঠনটিকে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছিল, তেমনি আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর উপর বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ কেউ আস্থা রাখলেও, বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে তার নেতৃত্ব নিয়ে।
নেতৃত্ব নির্বাচনে অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার জুনায়েদ বাবুনগরীর মৃত্যুর পর তার জানাজাতেই মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে নেতৃত্বে আনার ঘোষণা আসে। রাত ১১টার দিকে হাটহাজারী মাদ্রাসায় জুনায়েদ বাবুনগরীর জানাজায় ভারপ্রাপ্ত আমির পদে তার নাম ঘোষণা করেন হেফাজত মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী।
এখানে সংগঠনটি অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করেছে কিনা তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে বেশ জোরেশোরেই আলোচনা দেখা দিয়েছে। অনেকেই মনে করছেন নেতৃত্ব শূন্যতাকে পুঁজি করে কোন পক্ষ যেন সুযোগ নিতে না পারে, সেকারণেই এত দ্রুত ঘোষণা আসে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে।
পাশাপাশি আলোচনা না করে কিসের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, সেটি নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বিষয়টি হেফাজতে ইসলামের অনেক নেতাকেই বিস্মিত করেছে।
যে দুই কারণে প্রশ্ন নেতৃত্ব নিয়ে
ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পাওয়া মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী সদ্য প্রয়াত জুনাইদ বাবুনগরীর মামা। বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন কমিটিতে তিনি হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন হেফাজতের কমিটিতে তিনি ছিলেন সিনিয়র নায়েবে আমির।
মুহিবুল্লাহর দু’টো বিষয় নিয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। তার একটি হলো, তার বয়স এখন প্রায় ৯০ বছর। এত বয়স্ক ব্যক্তির পক্ষে কতটুকু সংগঠন পরিচালনা করা সম্ভব হবে এটাই অধিকাংশের প্রশ্ন। অনেকের সন্দেহ তিনি একটি চক্রের হাতের কাঠের পুতুল হয়ে থাকবেন।
অপরটি হলো, তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া আজিজুল উলুম বাবুনগরের মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন। ফটিকছড়ি থেকে হাটহাজারীকেন্দ্রিক বলয়ের এই সংগঠন তিনি কতটুকু পরিচালনা করতে পারবেন এ বিষয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এর আগে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপি জোট থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন।
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জানাজার নামাজে ইমামতি করে আলোচনায় আসেন তিনি।
গত মার্চে নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে চাপে পড়া হেফাজত একপর্যায়ে কমিটি বিলুপ্ত করতে বাধ্য হয়। পরে পাঁচ সদস্যের যে আহ্বায়ক কমিটি করা হয় সেখানেও মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী ছিলেন।
সংগঠনটির নেতৃবৃন্দের মধ্যে মতভেদ
হেফাজতের সাবেক নায়েবে আমির আবদুর রব ইউসুফী প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘উনি সংগঠনের আমির হন কীভাবে?’ হেফাজতে ইসলামের কোনো গঠনতন্ত্র নেই, সংগঠনের একটি অংশ এ বিষয়টির সুবিধা নিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন সংগঠনের সাবেক এই নেতা।
তিনি বলেন, ‘আল্লামা শফী সাহেব কিংবা পরবর্তীতে জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেবের দেশব্যাপী একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সেটাকে কাজে লাগিয়েই আমরা কাজ করেছি। কিন্তু নিয়মনীতি আগেও ছিল না, এখনও নাই।’
তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সংগঠনে স্বাভাবিকভাবে সভাপতি মারা গেলে কোনো সিনিয়র সহসভাপতি সেই দায়িত্ব পেলেও হেফাজতে ইসলামে তেমনটি দেখা যায়নি। এগুলো এখানে ফলো করা হয়নি। কোনো অনুষ্ঠানিক ফোরামের বৈঠক ছাড়া আমির নির্বাচন করা হলো।
‘সংগঠনের সিনিয়র নায়েবে আমিরকে না করে প্রধান উপদেষ্টা থেকে আমির নির্বাচন করা হলো। প্রধান উপদেষ্টার কাজ হলো আমির না থাকলে আমির হিসেবে একজনকে নির্বাচন করা। কিন্তু উনি নিজেই আমির হয়ে গেলেন। যেখানে কোনো নিয়মনীতি থাকে না, সেখানে কাজ কতটুকু হবে সেটা আপনারা বুঝে নেন।’
প্রসঙ্গত, ইউসুফী ২০১০ সালে হেফাজত প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনে জড়িত ছিলেন। তবে মার্চের শেষে ও এপ্রিলের শুরুতে সহিংসতার পর সংগঠনের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার পর বাদ পড়েন।
যদিও এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘নতুন আমিরের নেতৃত্বে সংগঠন দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আবদান রাখবে। উনি অনেক প্রবীণ আলেম। উনি কওমি অঙ্গনে পরিচিত ব্যক্তিত্ব। আমরা আশা রাখতে পারি, ওনার নেতৃত্বে আমরা আমাদের ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন করার জন্য সচেষ্ট থাকব।’
এদিকে হেফাজতের নেতারা বলছেন, চট্টগ্রামের বাইরে দায়িত্বপ্রাপ্ত মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর তেমন প্রভাব না থাকলেও হাটহাজারী মাদরাসা বলয়ের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পেয়েছেন। আল্লামা শাহ আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হয়েছিল, সেখানে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ায় জুনায়েদ বাবুনগরীপন্থিদের বেশ আস্থায় আসেন তিনি। সে বিষয়টি এবার তার নেতৃত্বে আসায় বেশ কাজে দিয়েছে।
তবে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘উনাকে কীভাবে আমির ঘোষণা দেয়া হলো এ বিষয়ে আমি কোনো কিছু জানি না। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে কেউ পরামর্শও করেননি। পরে শুনেছি, আমাদের মহাসচিব সাহেব সেখানে (হাটহাজারীতে) এমন ঘোষণা দিয়েছেন।’
হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক গোলাম রাব্বানী এ বিষয়ে বলেন, ‘যারা সেখানে (হাটহাজারীতে) উপস্থিত ছিলেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সংগঠনের আমির নির্ধারণ করা হয়েছে। যারা সেখানে ছিলেন না তাদের সঙ্গে ফোনে আলোচনা করা হয়েছে।’
হেফাজতে ইসলামের পতনের শুরু
মূলত আল্লামা শফীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ফাটল ধরে সংগঠনটিতে। মাদ্রাসায় হাঙ্গামার সময় তাকে চিকিৎসা দিতে বাধা, এমনকি অক্সিজেনের নল খুলে ফেলার মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছে প্রয়াত আমির আল্লামা শফীর পরিবার।
আর শফীর শ্যালক এই ঘটনায় হত্যা মামলা করেন বাবুনগরীর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা পিবিআই। এতে অবহেলাজনিত নরহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে এখনও বিচার শুরু হয়নি।
এরপর সংগঠনটিতে মূলত বড় ধরনের মতভেদ তৈরি হয় গত বছরের নভেম্বরে। সে সময় জাতীয় সম্মেলন করে বাবুনগরীকে আমির করে গঠিত কমিটিতে শফীপন্থিদের বাদ রাখা হয়।
ওই কমিটিতে স্থান দেয়া হয় বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক শতাধিক নেতাকে। তারা নতুন কমিটি গঠন করার পর হঠাৎ করেই সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে নামার হুমকি দিতে থাকে। এরপরই সরকারের রোষানলে বিপর্যয় নেমে আসে হেফাজতে ইসলামের উপর।
সংগঠনটি গত মার্চ মাসে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে নানামুখী হুমকি দিতে থাকেন সরকারকে। ফলে ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা দেখা দেয়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাণ্ডব ছিল নজিরবিহীন। হেফাজত নেতারা এ সময় বলতে থাকেন, দেশ চালাতে হলে সরকারকে তাদের কথা শুনেই চালাতে হবে।
কিন্তু এপ্রিলের শুরুতে হেফাজত নেতা মামুনুল হক নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে নারী সঙ্গীসহ অবরুদ্ধ হওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। হেফাজত নেতারা তাৎক্ষণিক সহিংসতা চালিয়ে ত্রাস তৈরি করলেও কয়েক দিন পরেই পাল্টে যায় প্রেক্ষাপট। সরকার যখন অভিযান শুরু করে, তখন চুপসে যায় হেফাজত।
নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার অভিযানের মুখে সরকারের সঙ্গে সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ার পর গত ২৬ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। নানা নাটকীয়তার পর গত ৭ জুন ৩৩ সদস্যের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। আগের কমিটির মধ্যে যারা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক ছিলেন, তাদের সবাইকেই বাদ দেয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত এখনও মেনে নেননি হেফাজতের শফীপন্থিরা। আল্লামা শফীর অনুসারীদের সঙ্গে সমঝোতার অংশ হিসেবে অবশ্য প্রয়াত আমিরের বড় ছেলে ইউসুফ মাদানীকে সহকারী মহাসচিব করা হয়। তবে ওই দিনই ইউসুফ মাদানী তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ