করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২৭৬ জন। এ নিয়ে চলতি মাসে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার এবং চলতি বছর মোট ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের সংখ্যা আট হাজার ৩১৭ জন।
সোমবার (২৩ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, ডেঙ্গু উপসর্গ নিয়ে চলতি বছর ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত সাত মাসে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ২৩ দিনে ২৫ জনের মৃত্যু হয়।
গত জানুয়ারিতে ৩২ জনের দেহে ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে বছর শুরু হয়েছিল। জুনে এটা ১৭২ জনে ওঠে। জুলাই মাসে সেটিই হয়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ২৮৬ জনে। তাতে সব মিলিয়ে এ বছরের প্রথম সাত মাসে ডেঙ্গুতে মোট শনাক্ত দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৫৮। জুলাই থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে। আগস্টে এসে চিত্রটি উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছে। ২৩ দিনে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৬৫৯ জনে।
গত এক দিনে ডেঙ্গু নিয়ে শুধু ঢাকা বিভাগের হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হয় ২৪৩ জন। অন্য বিভাগের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয় ৩৩ জন।
চলতি বছর এ নিয়ে ডেঙ্গু শনাক্ত হলো ৮ হাজার ৩১৭ জনের শরীরে। এসব রোগীর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে ৭ হাজার ১৩৪ জন। বর্তমানে ভর্তি রয়েছে ১ হাজার ১৪৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১ হাজার ৫৯ ডেঙ্গু রোগী।
প্রতিবছর বর্ষাকালেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ দেখা দেয়। ২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ মানুষ প্রাণ হারান। তবে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ওই বছর সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগে ১৭৯ জনের মৃত্যু ও লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর গত বছর সতর্ক অবস্থানে ছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তারপরও ২০২০ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জন, যাদের মধ্যে ৬ জন মারা যায়। গত বছর সংক্রমণের মাত্রা কম থাকলেও এ বছর পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড মহামারির মধ্যে করোনা ও ডেঙ্গু নিয়ে যেসব রোগী হাসপাতালে আসছেন, তাদের অনেকেরই স্বাস্থ্য জটিলতা বেশি। আগামী দিনে এ ধরনের রোগী বাড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার খুরশীদ আলম বলেন, ডেঙ্গু নিধনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত মার্চ মাসে সিটি করপোরেশনগুলোতে চিঠি দেয়া হয়েছে। তাতে মশার উৎপত্তিস্থলগুলো ধ্বংস করে দিতে বলা হয়েছিল। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি।
কোভিড মহামারির মধ্যে করোনা ও ডেঙ্গু নিয়ে যেসব রোগী হাসপাতালে আসছেন, তাদের অনেকেরই স্বাস্থ্য জটিলতা বেশি। আগামী দিনে এ ধরনের রোগী বাড়লে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।
ডেঙ্গু যেন না হয় তার ব্যবস্থা নিতে নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘ডেঙ্গু হলে নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য বিভাগ সেবা দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। তবে ডেঙ্গু যেন না হয়, সে জন্য সিটি করপোরেশনকে কাজ করতে হবে।’
ঢাকার যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রতি করা এক জরিপে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণের পাঁচটি করে ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের ১০০টি স্থানে এই জরিপ পরিচালনা করে। রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় গত ২৯ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালনা করে অধিদপ্তর। যার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪১টি এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৯টি স্থান রয়েছে। জরিপের সময় এসব এলাকার ৩ হাজার বাড়ি ও স্থাপনা পরিদর্শন করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তরের ৫টি ওয়ার্ড হলো— মগবাজার (নিউ ইস্কাটনে মশার ঘনত্ব শতকরা ৫৬.৭ ভাগ), বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা (নিকুঞ্জে ৪৮.৪ ভাগ), কল্যাণপুর (দারুস সালামে ৪৬.৭ ভাগ), মিরপুর-১০ (কাজীপাড়ায় ৪৩.৩ ভাগ), মহাখালী ও নিকেতনে ৪০ ভাগ।
ঢাকা দক্ষিণের ৫টি ওয়ার্ড হলো— বাসাবো (গোড়ান ৭৩.৩ ভাগ), এলিফ্যান্ট রোড (সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা ৬৬.৭ ভাগ), আর কে মিশন রোড (টিকাটুলীতে ৫০ ভাগ), বনশ্রীতে ৪০ ভাগ, মিন্টো রোডে (বেইলি রোডে ৪০ ভাগ) এডিস মশার ঘনত্ব পাওয়া গেছে।
বহুতল ভবনে এডিসের লার্ভা মেলে বেশি
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করা ‘মুনসুন এডিস সার্ভে ২০২১ অ্যান্ড কারেন্ট সিচুয়েশন অব ডেঙ্গু’ শীর্ষক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগ ছড়ানো এডিস মশার লার্ভা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে বহুতল ভবনগুলোতে। বিপরীতে সবচেয়ে কম লার্ভার দেখা মিলেছে বস্তি এলাকায়। তবে এ জরিপ সময় উপযোগী পদ্ধতিতে করা হয়নি অভিযোগ করে কীটতত্ত্ব, রক্তরোগ ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এ কারণে প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি।
গতকাল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেখানে জানানো হয়, অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার ২০টি দল তিন হাজার বাড়ির ওপর জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। মোট ১০ দিন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯৮টি ওয়ার্ডের ১০০টি এলাকায় জরিপটি চালানো হয়। জরিপে তিন হাজারের মধ্যে ৫৮৮টি গৃহস্থালিতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়। বাকি ২ হাজার ৪১২টি গৃহস্থালিতে এ মশার লার্ভা পাওয়া যায়নি। মোট পাঁচ ধরনের গৃহস্থালির মধ্যে বহুতল ভবনের ৪৪ শতাংশেই ছিল এডিসের লার্ভা। আর একক ভবনের ২৫ শতাংশ, নির্মাণাধীন ভবনের ১৮, বস্তি এলাকার ১০ ও খালি বা পতিত জমির ৩ শতাংশে ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায়।
গৃহস্থালিগুলোর সাত ধরনের স্থানে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এগুলো হলো প্লাস্টিকের ড্রাম, প্লাস্টিকের ঝুড়ি, ফুলের ট্রে ও টব, ফেলে দেয়া টায়ার, রঙের কৌটা, বিভিন্ন ধরনের পাত্র ও পানিতে প্লাবিত মেঝে। এর মধ্যে পানিতে প্লাবিত মেঝেতেই বেশি লার্ভা শনাক্ত হয় বলে জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় ৬ হাসপাতালকে বিশেষায়িত ঘোষণা
এডিস মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ক্রমশই বেড়ে যাওয়ায় রাজধানীর পাঁচটি ও গাজীপুরের একটি হাসাপাতলসহ মোট ছয়টি হাসাপাতালকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষায়িত হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সোমবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ থেকে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো হলো— স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল, আমিনবাজার ২০ শয্যা হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যা হাসপাতাল। ঢাকা মহানগরীর এই পাঁচটি হাসপাতাল ছাড়াও রয়েছে গাজীপুরের শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল।
আগের দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন সেন্টারে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, করোনা রোগীদের সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় সলিমুল্লাহ, আহসানুল্লাহ মেডিকেলসহ রাজধানীর নির্দিষ্ট বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দেওয়া হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৪৫
আপনার মতামত জানানঃ