মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তালিবান যখন আফগান ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তখনই দেশটিতে আমেরিকার যুদ্ধে জড়ানো নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। ট্রাম্প বলেছেন, দশকের পর দশক ধরে চলা যুদ্ধে ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছি’। একইসাথে আফগানিস্তানে যাওয়া মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত ছিল বলেও জানান তিনি।
ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে এমন মন্তব্য করেন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের এই সাবেক প্রেসিডেন্ট। খবর বিবিসি, ডয়েচে ভেলে
তিনি বলেন, ‘আমরা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছি… এটার পেছনে আমাদের হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ হয়েছে, লাখ লাখ জীবন চলে গেছে, কিন্তু আগের তুলনায় সেখানে কোন পরিবর্তন আসেনি। এটা সবচেয়ে বেশি খারাপ, কারণ সেখানে আপনাকে সবকিছু পুনর্নির্মাণ করতে হবে, এটা আসলে টুকরো টুকরো করে ফেলার মতো’।
তিনি আরও বলেন, ‘মধ্যেপ্রাচ্যে আমাদের দীর্ঘ বাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে আটকা যাওয়াটা চোরাবালিতে পড়ার মতোই ছিল বলে হতাশার কথা জানান সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতায় থাকাকালীন ইরাক, সিরিয়া এবং আফগানিস্তান থেকে সেনা তুলে নেওয়ার কথা জানান ট্রাম্প। ওই সব দেশে মার্কিন সেনাদের সময় নষ্ট এবং অর্থের অপচয় হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘চীন যখন এমন পরিস্থিতি দেখে তখন আমাদেরকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এটা আমাদের দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিব্রতকর ঘটনা’।
ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন সেনা পাঠানো আমেরিকার ইতিহাসে সব চেয়ে বড় ভুল। এ কথা বলেই তিনি জানিয়েছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ তার এই মন্তব্যে আঘাত পেতে পারেন। কিন্তু তিনি তার মতে অনড় থাকবেন।
ট্রাম্পের বক্তব্য, শুধু আফগানিস্তানে নয়, গোটা মধ্য প্রাচ্যে মার্কিন সেনা পাঠানোই ভুল সিদ্ধান্ত। তার কথায়, ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করেছি। এর জন্য আমাদের কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। হাজার হাজার মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। সব ধ্বংস হয়েছে’।
ট্রাম্পের দাবি, তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলে আফগানিস্তান থেকে সেনা ও মার্কিন নাগরিকদের প্রত্যাহার প্রক্রিয়া আরও সুন্দরভাবে সম্পন্ন হতো।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আফগানিস্তানে মার্কিন সেনার সংখ্যা ২০ হাজার থেকে কমিয়ে ২৫শ’তে নামিয়ে এনেছিলাম। আর এখন তারা বেসামরিক মার্কিন নাগরিক, আফগান দোভাষীসহ অন্য যারা আমাদের সাহায্য করেছিল, তাদের নিরাপদে বের করে আনার আগেই মার্কিন সেনাদের দেশে ফিরিয়ে আনলো। আমি ক্ষমতায় থাকলে অন্য সবাইকে আগে বের করে সবার শেষে সামরিক বাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে আনতাম’।
কিছুদিন আগে ট্রাম্প এভাবেই আক্রমণ করেছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। বলেছিলেন, আফগানিস্তানের বর্তমান অবস্থার জন্য বাইডেনের পদত্যাগ করা উচিত। গোটা পরিস্থিতির দায় বর্তমান প্রেসিডেন্টকেই নিতে হবে।
শুধু আফগানিস্তানে নয়, গোটা মধ্য প্রাচ্যে মার্কিন সেনা পাঠানোই ভুল সিদ্ধান্ত। তার কথায়, ‘আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস করেছি। এর জন্য আমাদের কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। হাজার হাজার মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তাতে কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। সব ধ্বংস হয়েছে’।
তবে ট্রাম্পের এইসব মন্তব্য ঘিরে একাধিক প্রশ্ন উঠছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ট্রাম্প যদি সত্যিই মনে করেন যে আফগানিস্তান সহ মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা পাঠানো ভুল সিদ্ধান্ত, তাহলে তার ক্ষমতাকালে তিনি সেনা প্রত্যাহার করলেন না কেন? ট্রাম্প অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, তিনি চেয়েছিলেন জুনের মধ্যে সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করা হোক। প্রশ্ন উঠছে, ক্ষমতায় এসেই সে কাজ করলেন না কেন তিনি? কেন এত বছর অপেক্ষা করলেন?
বাইডেন শিবিরের প্রশ্ন, তালিবানের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন ট্রাম্প। সেই চুক্তি নিয়ে এখন কী বলবেন তিনি? তালিবানের সঙ্গে সমঝোতা কি ঐতিহাসিক ভুল নয়? প্রশ্ন উঠছে, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করাও ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত। বাইডেন এসে কেবল তা রূপায়ণ করেছেন। ফলে আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য যদি বাইডেন দায়ী হন, তাহলে ট্রাম্প নন কেন?
আফগানিস্তানে মার্কিন বিপর্যয় বাইডেনের জন্য বিপদ
আফগানিস্তান তালিবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় বিপদে পড়ে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শুধু বিরোধী রিপাবলিকান পার্টি নয়, তার নিজের দলের সদস্যরাও জানতে চাইছেন কীভাবে তালিবান বাহিনী এত দ্রুত কাবুল দখল করে নিল। এক সপ্তাহ আগেও তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সঙ্গে কথা বলে তিনি আশ্বস্ত হয়েছিলেন, রাজধানী রক্ষায় সরকারি বাহিনী পুরোপুরি প্রস্তুত। হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়েছিল, রাজধানীতে তালিবান বাহিনী এসে পৌঁছাতে কয়েক মাস লাগতে পারে। এ কথা বলার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আশরাফ গনি সপরিবার দেশ ছেড়ে পালালেন। একটা গুলি খরচ না করেও তালিবান বাহিনী কাবুল দখল করে নিল।
গত সোমবার এক ভাষণে বাইডেন স্বীকার করেছেন, এত দ্রুত যে কাবুলের পতন হবে, তা কেউ ভেবে ওঠেনি। তবে অবস্থার সঠিক মূল্যায়নে তার সরকারের ব্যর্থতা স্বীকার করার বদলে তিনি সব দায়ভার চাপালেন আফগান সরকার ও সে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর ওপর।
তিনি বলেছেন, ‘যে যুদ্ধ করতে আফগান বাহিনীর সদস্যরা নিজেরাই আগ্রহী নন, তাতে অংশ নিয়ে মার্কিন সৈন্যদের মারা যাওয়ার কারণ থাকতে পারে না।’
বাইডেন মুখে বলেননি বটে, কিন্তু তার এই স্বীকারোক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জাজনক পরাজয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। পরাশক্তি হিসেবে নিজেদের ব্যাপারে মার্কিনরা গভীরভাবে গর্বিত। এই ভূমিকা ঐশ্বরিক, এমন কথায় বিশ্বাস করে এমন লোকের অভাব নেই।
২০০১ সালে আফগানিস্তান আক্রমণের পর প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছিলেন, ঈশ্বরের নির্দেশেই তিনি এই লড়াইয়ে নেমেছেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে তালিবান সরকারের পতন ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সেখানে নিজের পছন্দমতো সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। যুদ্ধে জিতলেও দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি, তালিবানকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। দুই দশক ধরে এক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র এখানে তিন লাখ সদস্যবিশিষ্ট আফগান সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। সঙ্গে রয়েছে কয়েক হাজার মার্কিন সামরিক উপদেষ্টা। তাদের প্রতিপক্ষ তালিবান বাহিনী, যারা সংখ্যায় বড়জোর ৭৫ হাজার। তাদের না আছে আধুনিক ট্যাংক বহর, না আছে কোনো বিমানবাহিনী। সেই তালিবানের হাতে এমন বিপর্যয় হলো কীভাবে?
ভাবা হচ্ছে, কাবুল বিপর্যয়ের কারণে বাইডেনকে কড়া মূল্য দিতে হতে পারে। মার্কিনরা নিজেদের অজেয় দেখতে ভালোবাসে। কাবুল বিমানবন্দরে আফগান নাগরিকদের মার্কিন পরিবহন বিমান ধরে আঁকড়ে ধরার দৃশ্য তাদের ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে আমেরিকানদের পলায়নের লজ্জাজনক স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে।
বাইডেন দাবি করেছেন, আফগানিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্ত সঠিক, শুধু তিনি নন, ট্রাম্পসহ তার একাধিক পূর্বসূরি এই চেষ্টা করে গেছেন। সে কথা ঠিক, কিন্তু ব্যর্থতার দায়ভার তারা কেউ বহন করবেন না, বাইডেনকেই বহন করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৬
আপনার মতামত জানানঃ