দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবস্থাই খারাপ অবস্থানে চলে গেছে। মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে অন্তত ১০টি ব্যাংক। ব্যাংকবহির্ভূত ১১ আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে বিপজ্জনক স্তরে। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ঢুকেছে আরো ১৮টি। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারেও চলছে তহবিল সংকট। দুর্নীতি, অনিয়মই এই সংকট সৃষ্টিতে প্রধান ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান রক্ষায় সরকারের পদক্ষেপের দুর্বলতাও দেখছেন অনেকেই।
জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় অনুযায়ী আয় হচ্ছে না। ঋণ আদায় কমে গেছে। আবার কমেছে আমানতের পরিমাণ। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের দায়দেনা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কমেছে সম্পদের পরিমাণ। এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। কমেছে ব্যাংকিং লেনদেনও। সার্বিকভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় বেড়েছে, কমেছে আয়। বেড়েছে খেলাপি ঋণও। তাই ঋণ আদায়ে দেয়া হয়েছে বড় ছাড়। সব মিলিয়ে আর্থিক খাতের ঝুঁকি মোকাবেলার সক্ষমতা কমে গেছে। এতে বেড়েছে ঝুঁকির মাত্রা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৭ নভেম্বর ২০২০, মঙ্গলবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতি তিন মাস পর পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। এবার জুন পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহক থেকে আমানত নিয়ে ঋণ প্রদান করে। সেই ঋণ খারাপ হয়ে পড়লে সেই অনুপাতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। আবার খারাপ ঋণের ওপর অতিরিক্ত মূলধন রাখার বাধ্যবাধকতাও রয়েছে। তবে দেশের সরকারি বেসরকারি ১০টি ব্যাংক সেই অনুপাতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে এসব ব্যাংক।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো বিভিন্ন কেলেঙ্কারির পর দীর্ঘদিন মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। আর সরকারি বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো বেশি সুদে তহবিল নিয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়ার কারণে ঘাটতিতে। আবার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ঘাটতি দেখা দিয়েছে অনিয়ম-জালিয়াতির কারণে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৩ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ১৫৯ কোটি টাকা। সরকারি খাতের বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ১০ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ১ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা।
এ ছাড়া বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। এ ছাড়া সাবেক ফারমার্স বা বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের ঘাটতি ২০ কোটি টাকা। যাত্রা শুরুর পর বিভিন্ন অনিয়ম জালিয়াতির কারণে ব্যাংকটি ঘাটতিতে রয়েছে। নতুন কার্যক্রম শুরু করা কমিউনিটি ব্যাংকের ঘাটতি ১৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির কোনো ঋণ খেলাপি হয়নি, তবে নিয়মানুযায়ী বিতরণ করা ঋণের বিপরীতে কিছু নতুন মূলধন বাড়ানোর বাধ্যবাধকতা দেখা দিয়েছে। জানা যায়, গত জুন শেষে ব্যাংক খাতে সার্বিক মূলধন ঘাটতি ১১ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। আর ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি ৪ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা।
দেশের ব্যাংকবহির্ভূত ৩৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টির অবস্থান রেড জোনে (সবচেয়ে খারাপ)। এ ছাড়া ইয়েলো জোনে বা ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় ১৮টি ও গ্রিন বা ভালো অবস্থায় রয়েছে মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। তবে প্রতিবেদনে কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এর আগে রেড জোনে ছিল ১০টি প্রতিষ্ঠান। এবার আরও একটি প্রতিষ্ঠান যোগ হয়েছে। ইয়েলো জোনে আগে ছিল ১৯টি প্রতিষ্ঠান, এবার ১৮টি। গ্রিন জোনে আগের মতো এবারও চারটি প্রতিষ্ঠানই রয়েছে। অর্থাৎ ইয়েলো জোন থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে রেড জোনে গেছে।
চাপ সহনশীল (স্ট্রেস টেস্টিং) প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন জোনে ফেলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ প্রতিবেদন তৈরিতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্যের অবস্থা এই চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়। রেড জোনে পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে তদারকি শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চাপ সহনশীল প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্রিন, ইয়েলো ও রেড-এই তিন জোনে ভাগ করা হয়। রেড জোনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমেটড, বাংলাদেশ ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি (বিএফআইসি), বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি), এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট (ফাস), ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স, রিলায়েন্স ফিন্যান্সসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
গত জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা, যা তাদের বিতরণ করা মোট ঋণের ১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানির বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে ৮৮৪ কোটি টাকা। বিতরণ করা ঋণের ৮৩ দশমিক ১২ শতাংশই খেলাপি। পিপলস লিজিংয়ের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিংহভাই খেলাপি। প্রতিষ্ঠানটিকে অবসায়ন করার প্রক্রিয়া চলছিল। এখন আবার এটিকে অবসায়ন না করে পুনর্গঠন করার উদ্যোগ চলছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এটিকে পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকাই খেলাপি।
পুঁজিবাজারের তহবিল সংকট চলছে জানিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের আহ্বান জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিটিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ তহবিলের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা এবং আইসিবিসহ স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলার, মার্চেন্ট ব্যাংকের জন্য চাওয়া হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংককে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে বলা হয়, পুঁজিবাজারে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতের লক্ষ্যে আইসিবিসহ অন্যান্য বাজার মধ্যস্থতাকারী তথা মার্চেন্ট ব্যাংকার, স্টক ব্রোকার, স্টক ডিলারের মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করাসহ সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিশেষ তহবিলে ৩ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ সুদে ১০ বছর মেয়াদি ঋণ দেবে। এ তহবিলের বিনিয়োগের সুদের হার হবে ৪ শতাংশ, যার ১ শতাংশ সিংকিং ফান্ডে জমা থাকবে। সিংকিং ফান্ড এমন একটি তহবিল, যা দায় পরিশোধে কাজে লাগানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, এই তহবিলের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ মার্চেন্ট ব্যাংকার, স্টক ব্রোকারস ও স্টক ডিলার কর্তৃক ইস্যুকৃত করপোরেট বন্ড/ডেট সিকিউরিটিজে (যার কুপন হার হবে ৬ থেকে ৭ শতাংশ) বিনিয়োগ করা হবে। এতে বলা হয়েছে, গঠিত এ তহবিলের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে আইসিবি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। ফলে এই খাতে সংকট অবধারিত ছিল। সরকার যদি ব্যাংকিং ও ফিন্যান্স সেক্টরকে কঠোর হস্তে সুনির্দিষ্ট নিয়ম কানুনের অধীনে ধরে না রাখতে পারে, তাহলে এখানে পরিবর্তন আসবে না। ঘুষ, আত্মসাত, পাচার, লুটপাটের সঙ্গে জড়িতদের বিচার করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কেবল এই পথে এগোলেই ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারে।
মিই/আরা/১৬৪০
আপনার মতামত জানানঃ