খুলনার রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নের শিয়ালী গ্রামের কয়েকটি মন্দির ভাঙচুর ও হিন্দু পরিবারের ওপর হামলার ঘটনার রেশ এখনো শেষ হয়নি। এরইমধ্যে বগুড়া জেলার শেরপুরে রাতের আঁধারে মন্দির থেকে কালী প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার (৯ আগস্ট) দিবাগত রাতের কোনো এক সময় এ ঘটনা ঘটে। আজ মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) বেলা ১২টার দিকে মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে থানায় একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, দুর্বৃত্তরা কালীমূর্তি ভাঙচুর করে মন্দিরের বাইরে ফেলে রাখে। শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের দক্ষিণ চণ্ডীযান গ্রামে করতোয়া নদীর পাশ থেকে মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে মূর্তিটি উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা অনিল জানান, তাদের ধারণা, সোমবার মধ্যরাতে কেউ বা কারা মন্দিরে ভাঙচুর করে একটি কালীমূর্তি মন্দির লাগোয়া রিপন কুমারের বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। রিপন সকালে ঘর থেকে বের হয়ে ভাঙা মূর্তি দেখে প্রতিবেশীদের ডেকে আনে।
চন্ডিজান কালীমাতা মন্দির কমিটির সভাপতি বিজয় চন্দ্র দাস জানান, রাত ২টার দিকে খবর পেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি মন্দিরের কালী প্রতিমা নেই। মূল প্রতিমা পার্শ্ববর্তী রিপন চন্দ্রের বাড়ির উঠানে রেখে এসেছে দুর্বৃত্তরা।
রিপন চন্দ্র দাস জানান, রাত ২টার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখি বাড়ির উঠানে কালী প্রতিমা। তারপর সবাইকে খবর দেই। পরে দেখতে পাই মন্দিরের প্রতীমা ভাঙচুর করা হয়েছে।
মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দাস বলেন, উপজেলার গাড়ীদহ ইউনিয়নের চন্ডিজান দক্ষিণপাড়া এলাকায় অবস্থিত কালীমন্দিরটিতে দীর্ঘদিন ধরে আমরা পূজা-অর্চনা করে আসছি। এক্ষেত্রে স্থানীয় লোকজন সবাই আমাদের পূজা-অর্চনা করতে সহযোগিতা করে আসছে। কারো সঙ্গে আমাদের কোনো শক্রতাও নেই। এরপরও এমন ঘটনা ঘটলো। যা কল্পনাও করতে পারছি না।
তিনি বলেন, প্রতিদিনের ন্যায় মঙ্গলবার সকালে এসে দেখি মন্দিরের প্রতিমাগুলো ভাঙা। এছাড়া কালী প্রতিমার কিছু অংশ অন্যত্র ফেলে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা মন্দিরটিতে হানা দিয়ে এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, খবর পেয়েই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। পাশাপাশি এই ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শেরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনাটি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে, এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ করেছেন বগুড়া জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি দীলিপ কুমার দেব, উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি নিমাই ঘোষ, সাধারণ সম্পাদক সংগ্রাম কুন্ডুসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক ধর্মীয় সংগঠনের নেতারা। তারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। সেই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত দুর্বৃত্তদের চিহিৃত করে গ্রেপ্তারপূর্বক আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের নিকট জোর দাবি করেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের বড়সড় কিছু ঘটনার পর অনেকে ভাবেন, এমন কিছু আর ঘটবে না। কিন্তু সে গুড়ে বালি। রামু, কক্সবাজার ঘটনার পর দলেবলে বড়সড় ঘটনা না ঘটলেও হামলা, খুন, রক্তপাত বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন কাগজের পাতায় রক্ত ছলকে পড়ে। প্রতিবছর শারদীয় পূজার আগে চলে প্রতিমা ভাঙার ঘটনা। এ পর্যন্ত এমন কোনো বছর যায়নি যে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি।
তারা বলেন, সমাজ যে কতটা অস্থির, তার ভেতরে দূষণের, অনৈতিকতা ও ব্যক্তিস্বার্থের প্রবলতা (সেই সূত্রে দুর্নীতিও) যে কতটা আলোড়ন সৃষ্টি করে চলেছে, তার বহিঃপ্রকাশ বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হচ্ছে না। উদার মানবিক চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজ থেকে দ্রুত উধাও হতে চলেছে। এর বিরুদ্ধে সংগঠিত ও সমন্বিত কার্যকর প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে সামান্যই, আন্দোলন তো দূরের কথা।
আরও বলেন, এসব তো সামাজিক অবক্ষয়, মূল্যবোধহীনতা ও সমাজদূষণের লক্ষণ। দীর্ঘস্থায়ী তৎপরতায় সমাজে পরিবর্তন ঘটানো ছাড়া এ রোগের নিরাময় ঘটবে না। আর এ ক্ষেত্রে দরকার হবে রাজনৈতিক দল-নির্বিশেষে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যার যার মতো করে। সমাজটাকে সুস্থ করে তুলতে পরিকল্পিতভাবে সমাজবদলের কাজে তৎপর হওয়া জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোরও রয়েছে নান্দনিক দায়, যা পূরণ করতে হবে বিনোদনের পাশাপাশি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। এ ধরনের ঘটনাকে প্রতিহত করার জন্য প্রশাসনের আরও সক্রিয়তা দরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতি ও মন্দির এলাকার নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক ও অশুভ শক্তিকে পরাভূত করে এই বাংলাদেশ, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর রক্তস্নাত এ দেশে তাদের কালো ছায়া কোনভাবেই আমরা দেখতে চাই না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৭
আপনার মতামত জানানঃ