নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশে ত্রাণ বিতরণ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতার অভিযোগ তুলে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত পিটার ফারেনহোলৎজ অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ছয় হাজার পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কর্মসূচি নিয়েছিলো ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাস। গত ১৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ব্যক্তিগত টুইট বার্তায় জার্মান রাষ্ট্রদূত তার অস্তুষ্টির কথা জানান।
জানা গেছে, গত ১৫ নভেম্বর সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ উদ্বোধন করেন ঢাকাস্থ জার্মান রাষ্ট্রদূত ফারেনহোল্টজ। স্থানীয় মাড়িয়ালা বাজার মোড়ে ২৫০০ পরিবারের মাঝে ২৫ কেজি চাল, এক কেজি ডাল, সাবান ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়। জার্মান রাষ্ট্রদূতকে ত্রাণ বিতরণকাজে সহায়তা করে বেসরকারি সংস্থা মীন ইনক্লুসিভ সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট। ত্রাণ বিতরণের সময় স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
জার্মান রাষ্ট্রদূত টুইট বার্তায় বলেন, সাতক্ষীরার কিছু রাজনীতিক ত্রাণ সাহায্যকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরা ঠিকমতো সেগুলো যাদের প্রয়োজন তাদের মধ্যে বিতরণ করতে পেরেছেন।
ত্রাণ বিতরণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘মিনা ইনক্লুসিভ সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্ট’ নামের বেসরকারী সংস্থাটির ম্যানেজার মনির হোসেন জানান, জার্মান দূতবাসের এই ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের সহায়তা নেন৷ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য কিছু লোকের সহায়তায় ওই এলাকা থেকে ২৫ জন স্বেচ্ছাসেবক নির্বাচন করা হয়৷ নির্বাচিত স্বেচ্ছাসেবকরা ত্রাণ পেতে পারেন এমন ২৫০০ লোকের তালিকা করে ত্রাণের টোকেন দেয়া হয়৷
মনির হোসেনের মতে, স্বেচ্ছাসেবকদের কেউ কেউ টাকার বিনিময়ে টোকেন বিক্রি করে৷ বিষয়টি এনজিও কর্মীরা ধরে ফেলায় টোকেন বাণিজ্যের সাথে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ত্রাণ বিতরণের শেষ দিকে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে৷ এমনকি তখন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানও তাদের ভুল বোঝেন বলে মনির হোসেন জানান৷
এনজিও সূত্রে জানা যায়, ২৫০০ লোকের জন্য ২৫ কেজি করে চাল নেয়া হলেও ত্রাণের জন্য অপেক্ষমাণ লোকের সংখ্যা বেশি হওয়াতে ২৫ কেজি ওজনের ২০০ ব্যাগ ভেঙে তারা ৪০০ করেন৷ এতে কিছু বিক্ষুব্ধ সেচ্ছাসেবক সাধারণ ত্রাণ প্রার্থীদের উত্তেজিত করে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে৷ নিরাপত্তার কারণে ত্রাণ বিতরণ বন্ধ করে চলে আসার উদ্যোগ নিলে স্থানীয় প্রসাশনের এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন৷ এবং জার্মান রাষ্ট্রদূত অসন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত ঢাকায় চলে যান।
জার্মান রাষ্ট্রদূতের ত্রাণ বিতরণের সময় কী ঘটেছিল জানতে চাইলে প্রতাপনগর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা নওশের আলী ও হিজলাকোলা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জেল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জাকির হোসেন ত্রাণসহ যেকোনো সরকারি বেসরকারি সহায়তা টাকার বিনিময়ে করে থাকেন। জার্মান দূতাবাসের ত্রাণের তালিকা ও বিতরণ তাঁর মাধ্যমে না করায় তিনি মনঃক্ষুণ্ন হন এবং ত্রাণ বিতরণের আগের দিন জার্মান সরকারের ত্রাণ দেওয়া হবে এমন কথা তাঁর পক্ষের লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেন। ফলে ত্রাণ বিতরণের সময় নির্ধারিত তালিকার বাইরে বেশি মানুষ জড়ো হয়। এমন পরিস্থিতিতে ত্রাণের প্যাকেট কম পড়ে এবং চেয়ারম্যানের মনোনীত লোকজন হৈচৈ ও বিশৃঙ্খলা শুরু করে।
প্রতাপনগর গ্রামের আব্দুস সামাদ ও কুড়িকাহনিয়া গ্রামের নুরে আলম অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা জাকির চেয়ারম্যান একই ব্যক্তিকে বারবার তালিকাভুক্ত করে ত্রাণ আত্মসাৎ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে এলাকাবাসী লিখিত অভিযোগও করেছে। জার্মান রাষ্ট্রদূতের ত্রাণ কার্যক্রম থেকেও লুটপাট করার বহু চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করায় তিনি সফল হতে পারেননি।
জানতে চাইলে ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ৬০০ ব্যক্তিকে ত্রাণ দেওয়া হয়। ওই সময় আমাকে ডাকা হয়। আমি জার্মান রাষ্ট্রদূতকে ত্রাণ বিতরণে সহায়তা করি। ত্রাণের তালিকা তৈরি বা এসংক্রান্ত কাজে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল জানান, তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের ২৫ কেজির ত্রাণের প্যাকেট দেওয়া হয়। একপর্যায়ে লোকজন বেশি জড়ো হয়ে যায়। এ সময় ২৫ কেজির ত্রাণের প্যাকেট ভাগ করে ১২ কেজি করে দেওয়া হয়। সে সময় ত্রাণ নিতে আসা অনেকেই আপত্তি তোলে। সহায়তাকারী এনজিওর কর্মকর্তারা তাঁকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ডেকেছিলেন বলেই তিনি সেখানে যান। পরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন সুলতানাসহ অন্যরা সেখানে যান।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন সুলতানা জানান, ত্রাণ বিতরণে ঝামেলা হচ্ছে এমন খবর শুনে তিনি সেখানে যান। লোকজন বেশি হওয়ায় চাহিদার তুলনায় ত্রাণের প্যাকেট কম ছিল। এ সময় দূতাবাসের মনোনীত এনজিওর কর্মীরা প্যাকেট ভাগ করে মানুষকে ত্রাণ দিয়েছে। তখন কেউ কোনো সমস্যার কথা বলেনি। আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম বরণ চক্রবর্তী জানান, ত্রাণ বিতরণের দিন তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে কোনো সমস্যা হয়নি।
ডিই/মিই/নসদ/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ