সংবাদ প্রকাশের জেরে পাবনা প্রেসক্লাবের সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন পাবনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু। গত ৯ জুন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে সাবেক সাংসদ এ মামলা করেন। খন্দকার আজিজুল হক বর্তমানে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।
সৈকত আফরোজ আসাদ সময় টিভি, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরডটকমের পাবনা জেলা প্রতিনিধি এবং পাবনামেইলটোয়েন্টিফোর ডটকমের সম্পাদক।
ঢাকার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান গত বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে সৈকতকে মামলার বিষয়টি অবহিত করেন। পরে পাবনার গণমাধ্যমকর্মীরা বিষয়টি জানতে পারেন।
মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, চলতি বছরের ৮ মার্চ সাংসদের পৈতৃক বাড়ি জেলার বেড়া উপজেলার নাটিয়াবাড়ি গ্রামে আমিনপুর থানা-পুলিশ একটি অস্ত্র তৈরি কারখানার সন্ধান পায়। এ সময় অস্ত্র তৈরির অভিযোগে দুই যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনা নিয়ে সৈকত আফরোজ সম্পাদিত পাবনা মেইল টোয়েন্টিফোর ডটকমে ‘সাবেক এমপির ভাতিজার বাড়িতে কারখানা, আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার, আটক ২’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সে প্রতিবেদন তিনি (সৈকত আফরোজ) তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও শেয়ার করেন।
এজাহারে সাংসদের দাবি, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সাংবাদিক সৈকত আফরোজ তাকে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে হেয় করতেই সংবাদটি প্রকাশ করেছেন। এ কারণে তিনি মামলাটি করেছেন।
মামলা প্রসঙ্গে সাবেক সাংসদ খন্দকার আজিজুল হক জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, গ্রেপ্তার যুবকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। যুবককে গ্রেপ্তারের প্রতিবেদনও বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কোথাও তাকে (সাংসদ) জড়িয়ে কিছু বলা হয়নি। শুধু সৈকত আফরোজ সম্পাদিত অনলাইন পোর্টালেই তাকে জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি এর প্রতিবাদপত্র দিয়েছিলেন, সেটিও ছাপা হয়নি। তাই আইনের আশ্রয় নিয়েছেন।
এজাহারের অভিযোগ প্রসঙ্গে সৈকত আফরোজ বলেন, কোনো সংবাদই মনগড়া তথ্যে হয় না। ঘটনায় গ্রেপ্তার মূল আসামি পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে নিজেকে সাংসদের ভাতিজা হিসেবে পরিচয় দিয়েছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
সৈকত আফরোজ বলেন, প্রতিবেদনে সাংসদের বক্তব্যও রয়েছে। সাংসদের ভাতিজা দাবি করা যুবকের বক্তব্যও সাংবাদিকদের কাছে সংরক্ষিত আছে। এখন তিনি আইনগতভাবেই বিষয়টি মোকাবিলা করবেন।
মামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পাবনা প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সামাজিক, পেশাজীবী ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা। তারা এই মামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
মামলা দায়েরের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সাংবাদিকরা বিবৃতিতে বলেন, সাবেক এমপি আরজু খন্দকারের বিরুদ্ধে যে কোন সংবাদ প্রকাশ হলেই তিনি সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সাথে অশোভন আচরণ করেন। অনৈতিক প্রস্তাবের মাধ্যমে সংবাদ বন্ধ করার চেষ্টা করেন। তাতে রাজি না হলে মামলা-হামলারও ভয় দেখান। সেই ধারাবাহিকতায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে অসত্য অভিযোগে পাবনা প্রেসক্লাব সম্পাদক সৈকত আফরোজ আসাদ’র বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। এতে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের স্বাধিনতার বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নিয়েছেন বলে আমরা মনে করি।
যুক্ত বিবৃতিতে সাংবাদিকরা আরো বলেন, আরজু খন্দকার যে সংবাদটি উল্লেখ করে মামলাটি দায়ের করেছেন, তা প্রকাশের আগে সাংবাদিকতার নীতিমালা মেনে তার বক্তব্য নিয়ে ওই সংবাদটিতে তা প্রকাশও করা হয়েছে। দেশের মূলধারার অধিকাংশ গণমাধ্যমগুলোতে একই সংবাদ প্রকাশিত হলেও সম্পূর্ণ আক্রোশ বশত কেবল পাবনা প্রেসক্লাব সম্পাদকের বিরুদ্ধেই তিনি মামলাটি দায়ের করেছেন।
পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এ বি এম ফজলুর রহমান বলেন, ‘অবিলম্বে মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলাটি প্রত্যাহার করা না হলে জেলার সব সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
তারা বলেন, সারা বিশ্ব দেখছে, এই দেশটি সাংবাদিক নিপীড়নকারী দেশ এবং গণমাধ্যমের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে এমন একটি দেশ। সাংবাদিকদের স্বাধীনতা চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা রাষ্ট্রের জন্য, সরকারের জন্য এবং সুশাসনের জন্য দরকার।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। এই আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের যেসব ঘটনা ঘটছে, পরিষ্কারভাবে তা গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকি।
তারা বলেন, বাংলাদেশে হত্যার আসামির দণ্ড মওকুফ হয় অথবা দ্রুত জামিন হয়, ঋণখেলাপি ও আর্থিক খাত থেকে লুটপাটকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, হাজার-কোটি টাকা বিদেশে পাচারকারী সহজেই দেশ ছাড়তে পারে, কিন্তু ফেসবুকে সরকারবিরোধী কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারের লোকজনের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যেন তার চাইতে বড় অপরাধ!
তারা বলেন, যে নিরাপত্তা আইন তৈরি করা হয়েছে, সে আইন নিয়ে বড় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, এ আইন কার জন্য করা হয়েছে? আইন তো তৈরি করা হয় সাধারণ জনগণের জন্য। এই আইন আসলে কার নিরাপত্তা দিচ্ছে? এ আইনে যারা বাদী হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ এমপি, মন্ত্রী ও প্রশাসনের লোকজন। আর যারা আইনের শিকার হয়েছেন তারা সাংবাদিক, লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। আমাদের সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের সাহস গড়ে তোলেন একজন লেখক, সাহিত্য, অ্যাক্টিভিস্ট ও সাংবাদিক। তারা যেন মুক্তভাবে কথা বলতে পারে সেজন্য তাদের সমর্থন করুন। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি নিপীড়নমূলক আইন গণতন্ত্রের দেশে থাকতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪১৬
আপনার মতামত জানানঃ