ব্লাসফেমি মামলায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৯ বছরের এক ছেলেকে জামিন দেয়ায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে একটি মন্দির ভাঙচুর করেছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী শতাধিক মানুষ। বুধবার ওই ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে বলে ডন ও বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভং শহরে এক মাদ্রাসায় শিশুছেলেটি প্রস্রাব করেছিল বলে অভিযোগ আছে।
সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৪ জুলাই দারুল উলুম আরবিয়া তেলিমুল কোরান মাদ্রাসার হাফেজ মোহাম্মদ ইব্রাহিমের অভিযোগের ভিত্তিতে ৯ বছরের ছেলেটির বিরুদ্ধে মামলা করে ভং পুলিশ। পাকিস্তান দণ্ডবিধির ২৯৫-এ ধারায় মামলাটি হয়।
মামলার পর মাদ্রাসা প্রশাসনের কাছে ক্ষমা চান স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বয়োজ্যেষ্ঠরা। তাদের ভাষ্য, আসামি অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী।
তবে চার দিন আগে ওই ছেলে জামিন পাওয়ায় বুধবার কয়েকজন ব্যক্তি আদালতের জামিন নির্দেশের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের প্ররোচিত করেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, লোকজন লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে গণেশ মন্দির ভাঙচুর করছেন। পরে ভাঙচুরকারীরা তিন ঘণ্টারও বেশি সুক্কুর-মুলতান সড়ক অবরোধ করেন।
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা রিয়াসাত আলী বলেন, ‘ভাঙচুরে মন্দির ভবনের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
রহিম ইয়ার খান জেলা পুলিশের মুখপাত্র আহমেদ নাওয়াজ চীমা জানান, ওই এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ইসলাম ধর্মের মহানবীকে অপমান করলে পাকিস্তানে বাধ্যতামূলকভাবে মুত্যুর সাজা হয়৷ প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে কঠোর ব্লাসফেমি আইন কার্যকর রয়েছে৷ পাকিস্তানে ব্লাসফেমির জন্য যতটা না ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি এই আইনের বলে সংঘবদ্ধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে৷
পাকিস্তানে এই আইনের সূচনা হয় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউল হকের অধীনে ১৯৮০ এর দশকে৷ এই আইন অনুযায়ী ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে অবমাননা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এছাড়া ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআনসহ নির্দিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিন্দা বা অবমাননায় কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে৷
গতবছরের সেপ্টেম্বরে ব্লাসফেমি বা ধর্মনিন্দার অভিযোগে এক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তানের আদালত৷ ৩৭ বছরের ঐ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইসলাম নিয়ে ‘অন্যায়’ এবং ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করেছেন তিনি৷ যদিও তার আইনজীবীর দাবি, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে না চাওয়ায় তার বিরুদ্ধে ধর্মনিন্দার অভিযোগ করা হয়৷ প্রায় সাত বছর ধরে বিচার চলার পরে নিম্ন আদালত তাকে ফাঁসির সাজা দেয়৷
এছাড়াও গতবছরের জুলাই মাসের শেষের দিকে পাকিস্তানের পেশোয়ারে তাহির নামিস নামে একজনকে বিচার চলাকালে আদালতকক্ষের ভিতরেই গুলি করে হত্যা করা হয়৷ তার বিরুদ্ধে ব্লাসফেমির অভিযোগ আনা হয়েছিল৷ ঐ ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় বিবৃতি দিয়ে নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ হত্যাকারীকে ‘ধর্ম যোদ্ধা’ অ্যাখ্যা দিয়ে তার মুক্তির দাবিতে তখন মিছিলও করে কয়েক হাজার কট্টর সমর্থক৷
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ধর্মবিরোধী এই ব্লাসফেমি আইনটি সাধারণত ধর্মীয় কট্টরপন্থিদের পাশাপাশি সাধারণ বহু পাকিস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়৷
তারা বলছে, সংখ্যালঘুদের দমনে এই আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এমনকি মুসলিমরাও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে একজন আরেকজনকে ব্লাসফেমি মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ব্লাসফেমির অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক৷ কেননা, অভিযুক্ত ব্যক্তি সহিংসতার ঝুঁকিতে পড়ছেন৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ বাড়ছে উল্লেখ করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার উস্কানিমূলক ঘটনা বন্ধে দেশটির নেতৃত্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা৷
তারা বলেন, পাকিস্তানের ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় সংবেদনশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে অস্পষ্টভাবে প্রণীত ব্লাসফেমি আইনগুলোর পুলিশ এবং বিচার বিভাগ নির্বিচারে প্রয়োগ করছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশেই ‘ব্লাসফেমি’, ‘ধর্মীয় অবমাননা’ এবং ‘ধর্মত্যাগ’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ বাস্তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রুতা, জমি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রেও হাতিয়ার করা হয় এসব আইনকে৷
আরও বলেন, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত অবরোধের মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকলেও তা কেবল কাগজে কলমে। হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, আহমদি এমনকি শিয়ারাও দেশটিতে অ-নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়। তাদের কথা বলার অধিকার নেই। আইনের সুরক্ষার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত।
এসডব্লিউ/এমএন/কে এইচ/১৭০২
আপনার মতামত জানানঃ