করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও দেশে নারী ও শিশুর প্রতি ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে অব্যাহত রয়েছে। কঠোর লকডাউনের মাস জুলাই মাসে মোট ১৮১ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং ৬৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
বুধবার সংস্থার সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়। সংস্থার লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৩টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
জুলাই মাসে নারী ও কন্যাশিশুর ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, এ মাসে মোট ১৮১ নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৭ জন। তাদের মধ্যে ২৮ শিশু ধর্ষণের শিকার, পাঁচজন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, দু’জন ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ও ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যার শিকার হয়েছে একজন।
এ ছাড়া চার শিশুসহ ৯ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। একজন শ্নীলতাহানির শিকার হয়েছে। এক শিশুসহ পাঁচজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অ্যাসিড দগ্ধের শিকার হয়েছে দু’জন। অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছে একজন। উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে এক শিশু। উত্ত্যক্তের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে একজন। পাঁচ শিশুসহ ছয়জন অপহরণের ঘটনার শিকার হয়েছে। নারী ও শিশু পাচারের ঘটনা ঘটেছে সাতটি। বিভিন্ন কারণে পাঁচ শিশুসহ ২৮ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়াও দু’জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।
যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৯ জন, তাদের মধ্যে দু’জনকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে সাত শিশুসহ মোট ১৩ জন। বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছে তিন শিশুসহ ১০ জন। পাঁচ কন্যাশিশুসহ ১৭ জনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বাল্যবিয়ে-সংক্রান্ত ঘটনা ঘটেছে দুটি। বাল্যবিয়ের চেষ্টা করা হয়েছে একটি। এক কন্যাশিশুসহ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছে ছয়জন।
এতে বলা হয়, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে ৪৩১ কন্যা শিশু ধর্ষণসহ মোট ৬৯৭ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তন্মধ্যে ৪১ জন কন্যা শিশুসহ দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৪ জন নারী ও কন্যা শিশু। ১২ কন্যা শিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ১৬ নারী ও কন্যা শিশু। ৩৪ কন্যা শিশুসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন ৪৬ নারী ও কন্যা শিশু। ১২ কন্যা শিশুসহ উত্ত্যক্তকরণের শিকার হয়েছেন ২২ নারী ও কন্যা শিশু। শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৯ কন্যা শিশুসহ ৯৯ নারী। হত্যার শিকার হয়েছেন ৬২ কন্যা শিশুসহ ২২১ নারী। বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে ২২ কন্যা শিশু।
গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে ৪৩১ কন্যা শিশু ধর্ষণসহ মোট ৬৯৭ জন নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তন্মধ্যে ৪১ জন কন্যা শিশুসহ দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৪ জন নারী ও কন্যা শিশু।
এদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং-বিষয়ক জুলাই মাসের প্রতিবেদনেও বলছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও দেশে নারী-শিশুর প্রতি ধর্ষণ, হত্যা ও পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বিগত মাসগুলোর মতোই অব্যাহত রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
এমএসএফ বলছে, জুলাই মাসে ধর্ষণের ৬২টি, গণধর্ষণ ২৫টি, ধর্ষণ ও হত্যার ৪টি ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে ৬ জন প্রতিবন্ধীসহ ৪৭ জন শিশু ও কিশোরী রয়েছে। ধর্ষণের শিকার ৬২ জনের মধ্যে ৩৭ শিশু ও কিশোরী রয়েছে। অন্যদিকে গণধর্ষণের শিকার ১৬ জন এবং ধর্ষণ-হত্যার ঘটনায় দুই শিশু ও কিশোরী রয়েছে। ধর্ষণচেষ্টার শিকার ২৬ জনের মধ্যে ১৭ জনই শিশু ও কিশোরী। যৌন হয়রানি ১৫টি ও শারীরিক নির্যাতনের ৩৯টি ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ২৭ জন শিশু-কিশোরীসহ মোট ৬৬ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলমান করোনা পরিস্থিতি সমাজে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। অপরাধপ্রবণতা বেড়ে গেছে সর্বক্ষেত্রে। নারী নির্যাতনের মতো অপরাধও সে কারণেই বাড়ছে। শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত বহু মানুষের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ লক্ষ করা যায়।
এইসব ঘটনার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দায়ী করে আসছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তারা বলছেন, এইসব ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাশালীরা জড়িত থাকায় তাদের বিচার হয় না। আবার অনেক সময় পুলিশ এইসব ক্ষমতাশালীদের গ্রেপ্তারও করে না। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও তারা আবার জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। ফলে এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে সমাজে খুব ভালো বার্তা যাচ্ছে না। এই কারণে এদের থামানোও যাচ্ছে না। এই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অবশ্যই অপরাধ কমে যাবে।
গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান যোগ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধর্ষণ, ধর্ষণ জনিত কারণে মৃত্যুর শাস্তি প্রসঙ্গে ৯(১) ধারায় এতদিন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর যদি মৃত্যু হয় বা গণধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হয় বা আহত হন, তাহলেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। সেই সঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই ন্যূনতম এক লক্ষ টাকা করে অর্থ দণ্ডের বিধান ছিল। সেই আইনে পরিবর্তন এনে ধর্ষণের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেই মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রাখা হয়েছে। সেই সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও থাকছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলেও একই শাস্তি হবে। যদি কোনো ব্যক্তি তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শ্লীলতাহানি করেন তাহলে এটি যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে। এজন্য ওই ব্যক্তির অনধিক ১০ বছর এবং ন্যূনতম তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা হবে।
এছাড়া পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে যদি কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তাহলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ওই ধর্ষণ সংঘটিত হয়েছে, তিনি বা তারা প্রত্যেকে হেফাজতের ব্যর্থতার জন্য, সর্বোচ্চ ১০ বছর কিন্তু ন্যূনতম পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।
নারী নির্যাতন কেন বাড়ছে এবং এ অপরাধ বন্ধ করতে কী করণীয়? এ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন, এটি সবাইকে বুঝতে হবে। এ মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব সমাজ ও সরকার উভয়ের। নারী নির্যাতন বন্ধের ক্ষেত্রে বিচারহীনতা বড় অন্তরায়। পরিস্থিতির কারণে নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ আইনের আশ্রয় নেয়, বিচারপ্রার্থী হয়। বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে চার শতাংশের কম নারী বিচার পায়। নারী নির্যাতন রোধ করতে প্রথমেই প্রয়োজন অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করা।
তারা বলেন, নারী নির্যাতনের বিচারের জন্য কঠোর আইন রয়েছে। ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান হয়েছে। কিন্তু আইন তো সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। তাই আইন এক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে আছে। অতএব কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে নারী নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করলেই এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১২
আপনার মতামত জানানঃ