বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাতীয় সংসদে তাঁর একটি ভাষণের অডিও শোনানো হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একটি বইয়ে এই ভাষণের যে বিবরণী এসেছে, সংসদে বাজানো অডিও তার সঙ্গে মেলেনি। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ক একটি অনুচ্ছেদ উক্ত বইয়ে উল্লেখ থাকলেও সংসদে বাজানো রেকর্ডে তা পাওয়া যায়নি। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, ভাষণের কোন দলিলটি সঠিক। সরকারপক্ষের সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অন্যদিকে সংসদের রেকর্ডে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ক অনুচ্ছেদটি না থাকা প্রসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরণের আলোচনা চলছে। কেউ কেউ রেকর্ডেই আস্থা রাখছেন, তাদের শঙ্কা, হয়তো বইয়ে তথ্যটি ভুলক্রমে এসেছে।
জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে গত ১৫ নভেম্বর ২০২০, রবিবার জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ প্রস্তাব গ্রহণের আগে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংসদে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অডিও শোনানো হয়। ৪৬ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের প্রণীত সংবিধান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন। স্বভাবতই ভাষণটিতে থাকার কথা রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা। কিন্তু সংসদে প্রচারিত অডিওতে মূলনীতির প্রথম তিনটি বিষয় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তা থাকলেও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে তাঁর বক্তব্যের অংশটি ছিল না।
পরবর্তীকালে অভিযোগ ওঠে, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া মূল বক্তব্য বাদ দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত সংসদের বিশেষ অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রচার করা হয়েছে। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে উপস্থাপন করা হয়নি এমন অভিযোগের পক্ষ নিয়ে আওয়ামীপন্থী ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন একটি পত্রিকাকে বলেন, ‘বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইচ্ছাকৃতভাবে বক্তব্যটি বাদ দেওয়া হয়ে থাকলে এটি গুরুতর অপরাধ। এ ব্যাপারে তদন্ত করে বিষয়টি জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও সাংবাদিক বেবী মওদুদ সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২-৭৫)’ বইটিতে সংযোজিত ভাষণের অংশে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটি ছিল এ রকম, ‘জনাব স্পিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবোও না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে, কারও বাধা দেওয়া ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না।’
আর সংসদে সম্প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রেকর্ডের অংশটি হলো, ‘আমাদের শুধু আপত্তি হলো এই যে পবিত্র ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে কী জুয়োচুরি, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানি, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যভিচার এই বাংলার মাটিতে চলেছে। ধর্ম পবিত্র। পবিত্র স্থানে রাখতে দেন। একে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। এখানে যদি কেউ আমাদের বলেন আমরা অধিকার খর্ব করেছি, অধিকার খর্ব করি নাই। সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য এই অধিকারটুকু আমাদের খর্ব করতে হয়েছে।’
সরকারপক্ষ শুরুতে বিব্রত বোধ করলেও দ্রুত বিষয়টি সামলে উঠে ব্যাখ্যা দিয়েছে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীই প্রথম বলেন যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অডিও ভার্সনটি বাংলাদেশ বেতার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই অডিওটি হুবহু শোনানো হয়েছে। সংসদে এটার কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া হয়নি। সংসদের ছাপানো প্রসিডিংসে যেটা আছে সেটা হার্ড কপি। সেটার মধ্যে যে কথাগুলো আছে, এটা ঠিক, তার অনেকটাই অডিও ভার্সনে নেই।
পরবর্তীতে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক হোসনে আরা তালুকদার বিষয়টিকে আরো খোলাসা করে জানান যে, অভিযোগটি পাওয়ার পর তিনি অডিও সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালককে দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখেছেন। তিনি নিশ্চিত হয়েছেন, যে অংশটুকু বাদ পড়েছে বলে অভিযোগ এসেছে, সেই অংশটুকু তাঁদের আর্কাইভে নেই। এ বিষয়ে তার ব্যাখ্যা হলো, ‘সে সময়ের প্রযুক্তিগত কারণে রেকর্ডের সময় ফিতা বদলাতে হতো। এতে দু-এক মিনিট সময় লেগে যেত। এ কারণে হুবহু ভাষণ কোনো রেকর্ডেই নেই।’
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই আলোচনা রাজনৈতিক বিরোধকে পুঁজি করে অনেকদূর পর্যন্ত ডালপালা ছড়িয়েছে। কেউ কেউ সংসদে বাজানো রেকর্ডকেই সঠিক ধরেছেন। তাদের মতে, বইয়ের তথ্যে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। সরকারবিরোধীরা অবশ্য এই ঘটনাকে ওই বইয়ের ‘চৌর্যবৃত্তি’ হিসেবেই তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসসচেতন মানুষরা বিষয়টিকে ‘ধামাচাপা’ না দিয়ে সঠিক তথ্যপ্রকাশের দাবি তুলেছেন।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে একজন লিখেছেন, ‘কিছু অংশ না বাজানো আর দুই ভাষণে দুই রকম বর্ণনা, দুটো ব্যাপার এক নয়। এখানে দুই রকম বর্ণনা আসছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে এমন প্রশ্ন তোলার সুযোগ কারা করে দিল। যারা এর জন্য দায়ী, তাদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। ধামাচাপা দেয়া নয়, সরকারের উচিত পুরো বিষয়টা নিয়ে গ্রহণযোগ্য বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে তদন্ত করানো।’
মিই/আরা/১০২০
আপনার মতামত জানানঃ