ফোটোগ্রাফার দানিশ সিদ্দিকির মৃত্যু নিয়ে নতুন তথ্য সামনে আসল। ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয়নি পুলিৎজার জয়ী সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকীর। তালিবান তাকে আটক করে পিটিয়ে হত্যা করেছে। বিশ্ববিখ্যাত পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকীর মৃত্যুর প্রায় দুই সপ্তাহ পর তার নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে নতুন এই তথ্য সামনে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ম্যাগাজিন।
স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) মার্কিন ম্যাগাজিন ওয়াশিংটন এক্সামিনারে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনার দিন আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনী ও তালিবানের মধ্যকার সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে দুর্ঘটনাক্রমে বা ক্রসফায়ারে নিহত হননি সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী। পরিচয় পাওয়ার পরই তাকে আটক করে ‘নির্মমভাবে হত্যা করেছে’ তালিবানের যোদ্ধারা।
পুলিৎজার জয়ী ভারতীয় সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকী আফগানিস্তান গিয়েছিলেন আফগান সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তালিবানের লড়াইয়ের ছবি তুলতে। রয়টার্সের প্রধান ফোটোগ্রাফার দানিশ এর আগেও একাধিকবার আফগানিস্তান গেছেন; তালিবানের ছবি তুলেছেন।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, আফগান বাহিনী যখন খবর পায় যে, তালিবান বাহিনী কান্দাহারে পাকিস্তান সীমানা দখল করে নিয়েছে, তখন আফগান বাহিনীর কনভয়ে দানিশ উঠে পড়েন। তাদের সঙ্গেই সীমান্তের কাছে পৌঁছে যান তিনি।
সীমান্ত থেকে কয়েকশ মিটার দূরে আফগান সরকারি বাহিনীর ওপর প্রথম আক্রমণ চালায় তালিবান যোদ্ধারা। আক্রমণের তীব্রতায় এক সময় আফগান সেনাবাহিনীর কনভয় দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়।
এসময় আফগান কম্যান্ডারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান দানিশ। তিনজন আফগান সেনার সঙ্গে তিনি অন্য দিকে ছিটকে যান। তার শরীরে স্প্লিনটারের আঘাত লাগে। সেনা সদস্যরা তাকে স্থানীয় একটি মসজিদে নিয়ে যান। সেখানে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।
এদিকে দানিশ এবং আফগান সরকারি বাহিনীর তিন সেনার মসজিদে আশ্রয় নেওয়ার খবর পৌঁছে যায় তালিবানের কাছ। তালিবানের একটি দল ওই মসজিদ আক্রমণ করে। ভেতরে ঢুকে তারা দানিশকে আটক করে। পরে পরিচয় জানতে পেরে তাকে নিয়ে চলে যায় তালিবান যোদ্ধারা। একপর্যায়ে তাকে অন্যদের সঙ্গে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, দানিশের মৃত্যুর পর যে ছবি পাওয়া গেছে, তাতে স্পষ্ট যে হত্যা করার আগে তার মাথার কাছে একাধিক আঘাত করা হয়েছে। তারপর বুলেট দিয়ে তাকে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। ক্রসফায়ার বা উভয়পক্ষের মধ্যে পড়ে মারা গেলে মৃতদেহে এ ধরনের আঘাত থাকতে পারে না।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের প্রধান চিত্র সাংবাদিক ছিলেন দানিশ সিদ্দিকী। তার বাড়ি ভারতের মুম্বাইয়ে। ৪০ বছর বয়সী এই সাংবাদিক জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্র ছিলেন। টেলিভিশন সাংবাদিক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরে চিত্র সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
মৃত্যুর পরে আফগান সরকারের সহায়তায় দানিশের মৃতদেহ বিমানে করে দিল্লিতে আনে ভারত সরকার। পরে রাজধানী নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় তাকে কবর দেওয়া হয়। অবশ্য দানিশের মৃত্যু নিয়ে ভারত এখনও সরকারিভাবে কোনো তথ্য দেয়নি।
তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলি দাবি তুলেছে, দানিশের মৃত্যুর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। যে ভাবে তাকে মারা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনের বিরোধী। কোনো সাংবাদিককে এভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে হত্যা করা যায় না।
এদিকে, দানিশ সিদ্দিকীর মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তা জানা নেই বলে দাবি তালিবান গোষ্ঠীর। পাশাপাশি দানিশের মৃত্যুতে দুঃখও প্রকাশ করা হয় তালিবানদের তরফ থেকে। এই বিষয়ে তালিবানের মুখপাত্র জুবাইদুল্লাহ মুজাহিদ সিএনএন-নিউজ ১৮-কে বলেন, ‘আমরা জানি না যে কোন পক্ষের গুলিতে দানিশ মারা গিয়েছেন।’
পাশাপাশি মুজাহিদ আরও বলেন, ‘ওয়ার-জোনে ঢোকা যে কোনো সাংবাদিকের উচিত আমাদের জানানো। আমরা তাদের খেয়াল রাখব। ভারতীয় সাংবাদিক দানিশ সিদ্দিকির মৃত্যুতে আমরা দুঃখিত। এটা দুঃখের বিষয় যে সাংবাদিকরা আমাদের না জানিয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে ঢুকছেন।’
উল্লেখ্য, ২০১০ সালে রয়টার্সে শিক্ষানবীশ চিত্র সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন দানিশ। তার ৬ বছরের মধ্যেই ইরাকের মসুলের যুদ্ধের ছবি তুলতে যান দানিশ। ২০১৫ সালে নেপালের ভূমিকম্পের ছবিও তোলেন। ২০১৯-২০ সালে হংকং আন্দোলন, ২০২০ সালে দিল্লির দাঙ্গার ছবিও তোলেন এই চিত্র সাংবাদিক। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করে ২০১৮ সালে ফিচার আলোকচিত্রে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল রয়েটার্সের যে দলটি, সিদ্দিকী সেই দলের অংশ ছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ