সম্প্রতি সৌদি আরবের একটি আইন সংশোধন করা হয়েছে; যার ফলে দেশটিতে বসবাসরত অভিবাসী নাগরিকদের ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা ও বিনিয়োগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সংশোধিত এই আইনে সৌদি আরবের নাগরিক নন এমন ব্যক্তিদের স্থানীয় স্পন্সর ছাড়াই ব্যবসা পরিচালনা করার সুযোগ রাখা হয়েছে; এতে করে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা।
মূলত ভিশন ২০৩০ এর আওতায় শ্রমবাজারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশ কিছুদিন ধরেই পরিবর্তন আনছে সৌদি সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় সৌদি আরবের অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হচ্ছে। যার সুবিধা পাবে সেখানে অবস্থানরত বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা।
এসব উদ্যোগের মাধ্যমে মূলত বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া, স্থানীয় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা এবং বিনিয়োগ সহায়তা ও উৎসাহমূলক কর্মসূচি দিয়ে বিদেশিদের আকর্ষণ করে অর্থনৈতিক সংস্কারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে সৌদি আরবে।
চার দশকের শোষণের অবসান
তবে এতোদিন বাধ্যতামূলক সৌদি স্পনসরদের নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে গিয়ে বাংলাদেশিরা যেভাবে শোষিত হয়ে আসছেন, তার আর কোনো সম্ভাবনা থাকছে না। সূত্র মতে, স্পনসররা প্রায়ই ‘ইকামা’ (অস্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমোদন) নবায়ন করার জন্য বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেন। কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই লাভের একটি অংশও নিয়ে নেন তারা।
এ বিষয়ে হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল এম এ রশিদ শাহ সম্রাট একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সৌদি স্পন্সররা তিন থেকে চার বছর পর ইকামা নবায়নের সময় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নেন। বিনা বিনিয়োগে ব্যবসার লাভও নেন তারা।’
সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মোশি একই গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বেশি মুনাফার দেখা পেয়ে স্পন্সররা বাংলাদেশিদের ব্যবসা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন; এমন অনেক নজির রয়েছে। তখন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা আইনি অনুকূলে না থাকায় পাল্টা লড়াই করতে পারেননি।’
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এ চর্চা চলছে এবং অবশেষে আইনে পরিবর্তন আসায় বাংলাদেশিরা স্পন্সরদের কবল থেকে মুক্তি পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
গত মার্চ মাসে কার্যকর হওয়া সংশোধিত এন্টি-কমার্শিয়াল কনসিলমেন্ট আইনের ফলে বাংলাদেশিরা এখন স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারবেন এবং দেশে আরও রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশোধিত আইন অনুসারে, যারা সৌদি নাগরিক ও যারা সৌদি নাগরিক নন; তারা সবাই চলতি বছরের ২৩ আগস্টের মধ্যে নিজেদের ব্যবসার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। এ ছাড়া, আরেকটি সংশোধনীর মাধ্যমে অবৈধ ব্যবসা পরিচালনার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান চালু করেছে সৌদি আরব।
রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, সৌদি আরবে বর্তমানে বিশ লাখের বেশি বাংলাদেশি বসবাস করছেন। তাদের অনেক বাংলাদেশি তাদের ব্যবসা নিবন্ধনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে কতজন নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন তা জানা যায়নি।
বাংলাদেশ দূতাবাসের একটি সূত্র জানায়, ব্যবসা নিবন্ধন করার মাধ্যমে সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বাধীনভাবে ও বৈধভাবে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবেন। জানা যায়, এমন অনেক বাংলাদেশি আছেন যারা বছরের পর বছর অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পরে ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা সৌদি স্পনসরদের নামে হোটেল, ক্যাটারিং, আরএমজি, কার্পেট, খেজুর ও খুচরা ব্যবসা করছেন। এখন তারা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারবেন।
নতুন সংশোধনীর সুবিধা-অসুবিধা
এ নীতির আওতায় ৮ লাখ সৌদি রিয়াল সমপরিমাণ অর্থ এককালীন প্রদানের মাধ্যমে সৌদি আরবে নতুন ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী হিসেবে যেকোনো অভিবাসীর নিবন্ধনের সুযোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া ১ লাখ সৌদি রিয়াল প্রদানের মাধ্যমেও এক বছরের জন্য বিনিয়োগকারী হিসেবে নিবন্ধনের সুযোগ রয়েছে।
এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে দূতাবাস অভিবাসীসহ সব বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীকে ২৩ আগস্টের মধ্যে তাদের ব্যবসার নিবন্ধন করতে বলেছে। সৌদি আরবের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এ নিবন্ধন সম্পন্ন করতে হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিবন্ধনে ব্যর্থ হলে আইনের আওতায় বিভিন্ন ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।
সুযোগ-সুবিধার প্রসঙ্গে দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সৌদি নাগরিক নন এমন নিবন্ধিত কোনো কোম্পানির মালিকরা বিশেষ সুবিধায় সৌদিতে বসবাসের অনুমতি পাবেন। তারা কর্মী নিয়োগ দিতে পারবেন এবং সম্পত্তির মালিক হতে পারবেন। এ ছাড়া, বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এককালীন আট লাখ রিয়াল দিয়ে সৌদিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যেতে পারে।
এই আইনে সৌদি নাগরিক ও বিদেশিদের মধ্যে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বের এবং বিদেশিদের কাছে কোম্পানি হস্তান্তরের সুযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি, বিদেশিরা সৌদি নাগরিকদের কাছে তাদের ব্যবসা বিক্রি করতে পারবেন এবং স্থায়ীভাবে চলেও যেতে পারেন।
তবে নতুন সংশোধনীতে সুবিধার মতো বেড়েছে আইন লঙ্ঘনে শাস্তিও। জানা যায়, আইন লঙ্ঘন করলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করে পাঁচ মিলিয়ন সৌদি রিয়াল (প্রায় ১১ দশমিক ২৯ কোটি টাকা) জরিমানা বা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
সৌদি নাগরিক ও বিদেশি-দুই শ্রেণির ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেই এ শাস্তি প্রযোজ্য হবে। এর আগে আইন ভঙ্গকারীদের ৫০ হাজার রিয়াল জরিমানা বা এক বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান ছিল।
সন্দেহ ও সম্ভাবনার মাঝে ব্যবসায়ীরা
বিজ্ঞপ্তিতে সব বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জরুরি ভিত্তিতে তাদের ব্যবসার নিবন্ধন করতে বলা হলেও সৌদি আরবের বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নতুন এই সুযোগটির বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
মক্কায় হোটেলের মালিক ওমর দেওয়ান সংবাদ মাধ্যম ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য উপকারী হবে কিনা আমরা নিশ্চিত নই। নিবন্ধনের পরে আমরা সৌদি সরকারের তত্ত্বাবধানে থাকব। কিন্তু অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে, আমাদের অভিযোগগুলো শোনা হবে কি না এবং সমাধান করা হবে কিনা সে ব্যাপারে আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না।’
ক্যাটারার ও হোটেল অপারেটর আবদুল্লাহ খায়াতের মতে, সৌদি সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ব্যবসায়ীদের সুবিধা ও সুরক্ষা দিচ্ছে না। করোনা মহামারির কারণে আমরা ইতোমধ্যে বিশাল ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছি। ব্যবসা নিবন্ধন করলে আমাদের সৌদি সরকারকে অতিরিক্ত কর দিতে হবে, যা বহন করা সম্ভব নয়।
তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আস্থাহীনতার বিষয়ে রিয়াদে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (অর্থনীতি) মুর্তুজা জুলকার নাইন নোমান বলেন, ‘যে কোনো নতুন উদ্যোগ নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে মানুষ এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এ মানুষগুলো শ্রমিক হিসাবে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। কাগজপত্রের বিষয়ে তাদের ভীতি আছে।’
এছাড়া গোলাম মোশির মতে, সৌদি সরকার মধ্যপ্রাচ্যে বিজনেস জায়ান্ট হয়ে ওঠার উদ্দেশ্যে এ উদ্যোগ নিয়েছে। তারা দেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত এগিয়ে চলছে। তাহলে তারা কেন নয়? এছাড়া এটি একটি অধ্যায়ের (শোষণ) অবসান ঘটাবে।’
তিনি আরও বলেন, একবার ব্যবসা নিবন্ধন করে ফেললে বাংলাদেশিরা সৌদি সরকার ও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে সব ধরনের সুবিধা পাবে। তারা শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে। বৈধভাবে উপার্জন করতে পারবে।
কনফেডারেশন অফ এশিয়া প্যাসিফিক চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমের মতে, সৌদি আইনের এ পরিবর্তন আরও বেশি বাংলাদেশির কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে এবং রেমিটেন্স বাড়াতে সহায়তা করবে।
তিনি বলেন, আগে বাংলাদেশিরা কেবল সৌদি নাগরিকদের সঙ্গে মালিকানা শেয়ার করে ব্যবসা করতে পারতেন। আমাদের ব্যবসায়ীদের জন্য এটি এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। এছাড়া, আমাদের অনেক ব্যবসায়ী বিদেশে ব্যবসা পরিচালনা করেন। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে তারা অনেক কঠিন সময় পার করছেন। এ উদ্যোগ তাদেরকে বিভিন্ন বাজারে বিনিয়োগের এবং ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের সুযোগ দেবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১৩৩
আপনার মতামত জানানঃ