নাইন ইলেভেনের পর থেকে বিভিন্ন সম্মুখ যুদ্ধে যতজন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে, তার থেকে বেশি মারা গেছে আত্মহত্যায়। বাউন ইউনিভার্সিটির দ্য কস্ট অব ওয়ার প্রোজেক্টের গবেষণা থেকে জানা যায়, মার্কিন সেনাবাহিনীতে কর্মরত ৩০ হাজার ১৭৭ সেনা (সেনাবাহিনীর যেকোনো পর্যায়ের কর্মরতরাই এই পরিসংখ্যানের আওতাভুক্ত) নাইন ইলেভেনের পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যা করেছে; যেখানে যেকোনো সম্মুখ যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৭ হাজার ৫৭ জন।
সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাদের মধ্যে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। ২০২০ সালে সামরিক বাহিনীতে ৩৮৫ জন সেনা সদস্য আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৮ সালে এই পরিমাণ ছিলো ৩২৬ জন। গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে এই পর্যন্ত আলাস্কায় আত্মহত্যা করেছেন ছয় জন। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্যারল গিয়াকোমো এ ব্যাপারে বলেছেন, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করছে। ধারনা করা হচ্ছে, ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে যেসব মার্কিন সেনা অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ গত দুই দশকে মার্কিন সরকারগুলো অযথা বিভিন্ন দেশে যেসব যুদ্ধ শুরু করেছে তা সেনাদের আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
যত বছর গড়াচ্ছে মার্কিন বাহিনীতে কর্মরত সেনা সদস্যদের আত্মহত্যার পরিমাণ বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। গতকাল সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন আলাস্কার ইয়েলসন বিমান ঘাঁটি পরিদর্শনের সময় এনিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আলাস্কা সফরে গিয়ে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, কেবল এখানে নয় বরং পুরো বাহিনীতে আত্মহত্যার হারে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আত্মহত্যায় একটা প্রাণ হারানোয় অনেক ক্ষতি। এই সমস্যা মোকাবেলায় আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি, আরও অনেক কিছুই করতে হবে।
আলাস্কায় মোতায়েন করা মার্কিন সেনারা কঠিন আবহাওয়া, ভূতাত্ত্বিক অবস্থান এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মধ্যে থাকেন। প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ এবং স্থান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাদের। এছাড়া যেসব সেনা সদস্য সাধারণ মানুষের বসবাসের এলাকায় থাকেন তাদেরও জীবন যাত্রায় ব্যয় অনেক বেশি।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পেন্টাগনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশেষ করে পুরনো সেনা সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। প্রত্যাহার করে আনার পরও অনেকে আত্মহত্যা করেছে। এ পরিস্থিতিতে পেন্টাগন এই আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। মার্কিন সেনা সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার সামাজিক প্রভাবের বিষয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে সেনা সদস্যদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও নজিরবিহীনভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে যে সংখ্যক মার্কিন সেনারা প্রাণ হারিয়েছে, তার চেয়ে বেশি মারা গেছে আত্মহত্যা করে। ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাস নির্মূলের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এসব যুদ্ধ শুরু করে এবং এ পর্যন্ত বহু মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে। এ সব যুদ্ধে কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি এবং কতোদিন এ যুদ্ধ চলবে তারও কোনো ঠিক ছিল না। ফলে সেনাদের মধ্যে মারাত্মক হতাশা দেখা দেয়। এসব হতাশা থেকেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে সবচেয়ে বেশি। ২০১৮ সালে কর্মস্থলেই আত্মহত্যা করেছে ৩২৬ মার্কিন সেনা, ২০১৯ সালে ৩৪৮ এবং ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭৭ জনে।
পেন্টাগনের পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় মার্কিন সেনাদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা ও হতাশা বিরাজ করছে; যা কিনা গত দুই দশকের ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধের প্রভাব। কেননা প্রচণ্ড মানসিক চাপ সহ্য করে তাদেরকে যুদ্ধের দিনগুলো পার করতে হয়েছে।
শুধু আফগানিস্তানের যুদ্ধেই যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে দুই ট্রিলিয়ন ৪০ হাজার কোটি ডলার। আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার পর গত ২০ বছরের সহিংসতায় এ পর্যন্ত ২৪০০ এর বেশি মার্কিন সেনা নিহত এবং আহত হয়েছে আরো হাজার হাজার সেনা।
এরপর ২০০৩ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই মার্কিন সরকার ইরাকে হামলা চালিয়ে দেশটি দখল করে নেয়। ইরাক যুদ্ধে অন্তত ৫০০০ মার্কিন সেনা নিহত এবং আরো হাজার হাজার সেনা আহত হয়েছে।
লক্ষ্যহীন ও বিরামহীন এসব যুদ্ধে জড়িয়ে হাজার হাজার মার্কিন সেনা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছে এবং এমনকি দেশে ফিরে গিয়েও তারা মানসিক ও পারিবারিক সংকট থেকে মুক্ত হতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত এমন সব সংকটের সম্মুখীন তাদেরকে হতে হয়েছে বা এখনো হচ্ছে যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে তাদেরকে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রায় সব মার্কিন সেনা ৪০ দিনের বেশি সম্মুখ ফ্রন্টে থেকে যুদ্ধ করেছে এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত হয়তো তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ভুগতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন সেনাদের হতাশা ও মানসিক রোগের একটি বড় কারণ হচ্ছে ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ চলাকালে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের অমানবিক আচরণ ও সেনা কমান্ডারদের দুর্ব্যবহার।
বিশেষ করে অযথা সামরিক অভিযান পরিচালনার সময় সাধারণ মানুষের ওপর তারা যে হত্যাকাণ্ড ও নৃশংসতা চালিয়েছে, পরবর্তীতে এর প্রভাব সেনাদের ওপরও গিয়ে পড়েছে। অর্থাৎ অপরাধবোধ থেকে মানসিক রোগ এবং সেখান থেকে আত্মহত্যার পথে তারা পা বাড়িয়েছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১৪১
আপনার মতামত জানানঃ