বান্দরবানে এক শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত মানবাধিকার নেত্রী ও অ্যাডভোকেট সারাহ সুদীপা ইউনুছকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শনিবার (২৪ জুলাই) সকালে তাকে বান্দরবান শহরের বনরুপা পাড়ার নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ২২ জুলাই রওশন আরা নামে এক নারী ওই শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে বান্দরবানের মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সারাহ সুদীপা ইউনুছ ও তার স্বামী কোয়ান্টামের অর্গানিয়ার লিগ্যাল অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট ফয়সাল আহমেদকে আসামি করে সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে বান্দরবান সদর হাসপাতালে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও চিকিৎসার করে আদালত নিয়ে গেলে আদালত ভুক্তভোগী শিশুটিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সেফহোমে (নিরাপদ আবাসন) প্রেরণের নির্দেশ দেন। এরপর শুক্রবার শিশুটিকে সেফহোমে পাঠানো হয়।
বান্দরবান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) মো. সোহাগ রানা বলেন, শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের অভিযোগে বান্দরবান সদর থানায় সারাহ সুদীপা ইউনুছ (৪০) ও তার স্বামী ফয়সাল আহম্মেদ (৪৫) এর নামে শিশু আইন, ২০১৩ এর ৭০/৮০(১) এর ধারায় একটি মামলা দায়ের করেছেন তার এক প্রতিবেশী রওশানা আরা, এর পরিপ্রেক্ষিতে অভিযান পরিচালনা করে মামলার আসামি সারাহ সুদীপা ইউনুছকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
জানা যায়, বান্দরবানে এক শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। নির্যাতিত শিশুটি জানায়, তাকে জ্বলন্ত মশার কয়েল দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতেন গৃহকর্তী সারাহ সুদীপা ইউনুছ। পরে শিশুটির এক প্রতিবেশী বাদী হয়ে গৃহকর্তী সারাহ সুদীপা ইউনুছ ও তার স্বামী ফয়সাল আহম্মেদ এর নামে বান্দরবান সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, শহরের বনরূপাপাড়ার ফয়সাল আহম্মেদ ও তার স্ত্রী সারাহ সুদীপা ইউনুছের বাসায় ৯ বছরের শিশু জয়নাব আক্তার ওরফে জোহরা গৃহকর্মীর কাজ করত। তারা বিভিন্ন অজুহাতে জয়নাবকে আট মাস ধরে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করছিলেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত সোমবার দরজা খোলা পেয়ে জয়নাব বাসা থেকে পালিয়ে যায়। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যায় ফয়সাল ও সারাহ সুদীপা পালিয়ে যাওয়া জয়নাবকে ধরে নিয়ে আসেন। জয়নাবের ডান হাতে, বাহুতে দগদগে ঘা, পেটে জ্বলন্ত মশার কয়েলের ছ্যাঁকার কালো ক্ষত ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন রয়েছে।
রওশন আরা গত বছরের নভেম্বরে ফয়সাল ও সারাহ সুদীপার বাসায় লামা থেকে এনে জয়নাবকে গৃহকর্মী হিসেবে দেন। জয়নাবের জন্মের পর তার মা অন্য কোথাও চলে যান, কয়েক বছর আগে বাবাও তাকে রেখে গেছেন। অসহায় বৃদ্ধ দাদির কাছে জয়নাব থাকে। তার যাওয়ার আর কোথাও জায়গা নেই।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও চিত্রে জয়নাবের শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে তার ওপর নির্যাতনের কথা জানায় শিশুটি। সে বলেছে, আট মাস ধরে বাসা থেকে বের হতে পারেনি। সোমবার সকালে বাসার দরজা খোলা পেয়ে পালিয়েছে।
শহরের বনরূপাপাড়ার ফয়সাল আহম্মেদ ও তার স্ত্রী সারাহ সুদীপা ইউনুছের বাসায় ৯ বছরের শিশু জয়নাব আক্তার ওরফে জোহরা গৃহকর্মীর কাজ করত। তারা বিভিন্ন অজুহাতে জয়নাবকে আট মাস ধরে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করছিলেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত সোমবার দরজা খোলা পেয়ে জয়নাব বাসা থেকে পালিয়ে যায়।
মামলার আসামি ফয়সাল আহম্মেদ ও তার স্ত্রী সারাহ সুদীপা ইউনুছ দুজনই আইনজীবী এবং সারাহ সুদীপা ইউনুছ মানবাধিকারকর্মী হিসেবেও পরিচয় দিয়ে থাকেন।
তবে সারাহ সুদীপা ইউনুছ বলেন, তাদের বিরুদ্ধে আনা শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক। তিনি একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে নির্যাতন করার প্রশ্নই ওঠে না। পালিয়ে যাওয়া জয়নাবকে সোমবার সন্ধ্যায় একজন পৌর কাউন্সিলরের উপস্থিতিতে সুস্থ অবস্থায় রওশন আরার কাছে হস্তান্তর করা হয়। এক দিন পর মঙ্গলবার জয়নাবকে নির্যাতনের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়। রওশন আরা একসময় তাদের বাসায় কাজ করার সময় টাকা চুরি করেছিলেন। সেই ক্ষোভে তাদের ফাঁসানোর জন্য জয়নাবের নির্যাতনের ঘটনা সাজিয়ে সুনাম ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছেন।
জেলা শহরের হাফেজঘোনার বাসিন্দা রওশন আরা বলেছেন, জয়নাব পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ফয়সাল ও সারাহ সুদীপা টাকা চুরির মিথ্যা কথা বলে জয়নাবকেসহ তাকে মামলায় ফাঁসানো হুমকি দিচ্ছেন। অথচ জয়নাব পালানোর বিষয়টি তিনি জানতেন না। তার কাছে হস্তান্তরের পর পালানো ও নির্যাতনের ব্যাপারে জেনেছেন।
প্রসঙ্গত, সারাহ সুদীপা ইউনুস, ফয়সাল আহমেদকে বিয়ে করার পর ফয়সাল আহমেদ বান্দরবানে এসে কোয়ান্টামের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, প্রয়াত বোমাং রাজা কেএস প্রু এর কন্যা মানবাধিকার নেত্রী ডনাই প্রুপ নেলীর সহযোগিতায় রাতারাতি বান্দরবানের মানবাধিকার নেত্রী বনে যান সারাহ সুদীপা ইউনুস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু গৃহকর্মীরা এ শারীরিক ও মানসিক আঘাত পাওয়া তাদের অনেকেই ভাগ্যলিপি বলে মেনে নিয়েছে। তাদের অধিকার, পাওনার কথা খুব কমই গোচরে আসে। গোচরে আসে কেবল তখনই, যখন তারা মৃত্যুশয্যায়। যে মা-বাবা তাদের প্রিয় সন্তানকে অভাবের তাড়নায় বাসায় কাজ করতে পাঠায় তারা মনে করে হয়তো ভালোই আছে তাদের আদরের সন্তান। তবে বাস্তবতা হলো দু’টির জায়গায় তিনটি মরিচ পোড়ানোর জন্য, ভাত বেশি গলে বা পুড়ে গেলে, গৃহকর্ত্রীর সন্তান একটু আঘাত পেলে, প্লেট ভেঙ্গে ফেললে, আরো কত রকম কারণে একজন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার তার হিসাব কেউ রাখে না। অনেক সময় তারা যৌন নির্যাতনেরও শিকার হয়।
তারা বলেন, একজন মানবাধিকারকর্মীর হাত থেকেও শিশুরা রেহাই পাচ্ছে না। শিশু শ্রম দেশে নিষিদ্ধ জেনেও বাসায় শিশু শ্রমিক রাখা, একইসাথে মধ্যযুগীয় কায়দায় শিশুকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের চিত্রই বলে দেয় শিশুরা দেশে কতটা অনিরাপদ।
তারা বলেন, অবস্থা দেখে মনে হয়, এদেশে ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন বন্ধ হওয়ার নয়। একেবারে লাগাতার ‘চলছে ও চলবে’ পরিস্থিতি। নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের অপরাধের গুরুত্ব বুঝে এদের দ্রুত বিচার আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি কার্যকর করা উচিত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে এটা যেমন সুখের ও গৌরবের তেমনি বিপরীতক্রমে ধর্ষক ও নির্যাতকের দেশ হিসেবে আমাদের যে পরিচিতি হচ্ছে সেটা চরম লজ্জার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৭
আপনার মতামত জানানঃ