করোনাভাইরাসের থাবায় বিশ্বজুড়ে মানুষ প্রিয়জন হারাচ্ছে। করোনার কামড়ে কত যে মানুষ প্রিয়জন হারিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। এমন প্রেক্ষাপটে দ্য ল্যানসেটের এক নতুন গবেষণায় যে তথ্য মিলল, তা দেখলে শিউরে ওঠার মত। গোটা দুনিয়ায় ১৫ লক্ষ শিশু তাদের বাবা-মা কিংবা অভিভাবক হারিয়েছে। এর মধ্যে ১০ লাখ ৪২ হাজার শিশু হয়তো পিতাকে, না হয় মাতাকে, অথবা উভয়কেই হারিয়েছে।
বিশ্বখ্যাত মেডিকেল সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন সায়েন্স ব্লগ।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, করোনাভাইরাস মহামারির প্রথম ১৪ মাসে বিশ্বজুড়ে অন্তত ১৫ লাখ শিশু তাদের বাবা-মা, দাদা-দাদি অথবা অন্যান্য স্বজনদের হারিয়েছে; যারা এই শিশুদের পরিচর্যা করতেন। মহামারি শুরুর পর থেকে গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই শিশুরা এতিম হয়েছেন। এর মধ্যে ১০ লাখ ৪২ হাজার শিশু তাদের পিতা-মাতা হারিয়ে এতিম হয়েছে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এতিম ওই শিশুদের বাবা-মা, দাদা-দাদি অথবা অন্যান্য স্বজনদের করোনায় মৃত্যুর এই তথ্য ২১টি দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। করোনায় বিশ্বে এখন পর্যন্ত যত মানুষ মারা গেছেন; তার ৭৭ শতাংশই ওই ২১ দেশে রেকর্ড করা হয়েছে।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে করোনা সংক্রান্ত মৃত্যুতে কমপক্ষে ১১ লাখ ৩৪ হাজার শিশু তাদের পিতামাতা বা ‘কাস্টডিয়াল প্যারেন্ট’কে হারিয়েছে।
এর মধ্যে ১০ লাখ ৪২ হাজার শিশু হয়তো পিতাকে, না হয় মাতাকে, অথবা উভয়কেই হারিয়েছে। তবে বেশির ভাগই পিতামাতার মধ্যে একজনকে হারিয়েছে। ১৫ লাখ ৬২ হাজার শিশু হয়তো তার পিতামাতার একজনকে, না হয় ‘কাস্টডিয়াল প্যারেন্ট’ অথবা যাদের সঙ্গে তারা থাকেন তাদেরকে হারিয়েছে। সবচেয়ে বেশি যেসব শিশু তাদের ‘প্রাইমারি’ অভিভাবককে (পিতামাতা অথবা আইনগত অভিভাবক) হারিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, পেরু, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, ব্রাজিল ও মেক্সিকো।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, করোনায় মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের চেয়ে পুরুষের সংখ্যা বেশি। সব মিলে মাকে হারিয়েছে যেসব শিশু তার চেয়ে ৫ গুন বেশি শিশু তার পিতাকে হারিয়েছে।
মহামারিতে কিভাবে শিশুরা এতিম হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। একই সঙ্গে কিভাবে শিশুদের পরিণতি নির্ধারিত হচ্ছে তা তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে শিশুদের অর্থনৈতিক সাপোর্টও হারিয়ে যাচ্ছে।
এতে যেসব শিশু করোনা ভাইরাসের কারণে একেবারে এতিম হয়ে গেছে, আইনগত অভিভাবক হারিয়েছে অথবা যাদের অভিভাবকত্বে তারা বসবাস করতো তাদেরকে হারিয়েছে, সেসব শিশুকে ধরা হয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজের অর্থায়নে এই গবেষণা করা হয়। এরপর ‘কোভিড-১০-এসোসিয়েটেড ডেথস’ শীর্ষক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। কোভিড-১০ এবং লকডাউনের মতো পরোক্ষ কারণগুলোতে যেসব মৃত্যু ঘটেছে সেগুলো এতে ধরা হয়েছে।
এই গবেষণায় দেখার চেষ্টা করা হয়েছে যে, শিশু বা তরুণদের ওপর কিভাবে মানসিক ক্ষত সৃষ্টি করছে করোনা মহামারি।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজের পরিচালক নোরা ডি ভোলকাউ বলেছেন, বিশ্বজুড়ে পরিবারগুলোর ওপর কিভাবে দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি বহন করে আনছে করোনা মহামারি এই গবেষণায় সেক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে শিশুদের ভবিষ্যত মানসিক সুস্থতা ও মঙ্গলের বিষয়টিও নির্ধারণে সহায়ক। অভিভাবককে হারিয়ে একটি শিশু যে মানসিক ক্ষতের শিকার হয়, তা হতে পারে বিপর্যয়কর। এক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করা উচিত। আমাদেরকে এমন হস্তক্ষেপ করে এসব শিশুকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) কোভিড-১৯ মোকাবিলা দলের সদস্য চিকিৎসক সুসান হিলিসের নেতৃত্বে একদল গবেষক করোনা এতিম শিশুদের বিষয়ে ওই গবেষণা করেছেন।
এক বিবৃতিতে সুসান হিলিস বলেছেন, বিশ্বজুড়ে করোনায় প্রত্যেক দু’জনের মৃত্যুতে অন্তত একজন শিশু তাদের বাবা-মা অথবা অন্য পরিচর্যাকারীকে হারিয়েছেন। করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় এতিম শিশুদের সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
মার্কিন এই চিকিৎসক বলেছেন, এই শিশুদের অগ্রাধিকার এবং ভবিষ্যতে অনেক বছর ধরে তাদের সহায়তা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়বে।
গবেষক দলের আরেক সদস্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লুসি ক্লাভার বলেছেন, আমাদের আরও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ প্রত্যেক ২ সেকেন্ডে একজন শিশু তাদের পরিচর্যাকারী হারিয়ে ফেলছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ