বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়তে যাদের মুখ্য ভূমিকা সেই প্রবাসী বাংলাদেশিরাই এখন কঠিন বিপদে। প্রথমে টিকার সংকট তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনে আর এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং য়ুরোপে চীনের টিকা ও কোভিশিল্ডের গ্রহণযোগ্যতা নতুন করে বিপাকে ফেলেছে তাদের।
সৌদি আরব ও কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যগামীরা চীনের টিকা নিলে তা গ্রহণযোগ্য বলে গণ্য করা হচ্ছে না। গতকাল বৃহস্পতিবার রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে এমনটি জানিয়েছে। চীনের যে কোনো টিকা নিয়ে সৌদি আরব ও কুয়েতে পৌঁছালে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক। এই কোয়ারেন্টাইনের জন্য বাংলাদেশি ৭০ হাজার টাকা খরচ করতে হবে প্রত্যেকের। এদিকে, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাকে ছাড়পত্র দিলেও কোভিশিল্ড নিয়ে আপত্তি তৈরি করছে খোদ ব্রিটেন।
যে যে টিকা মধ্যপ্রাচ্যে গ্রহণযোগ্য
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে অবস্থানরত সৌদি প্রবাসীরা শুধু চার ধরনের টিকা নিয়ে সৌদি আরব ফিরতে পারবেন। এর বাইরে অন্য কোনো টিকা নিলে তাদের গ্রহণ করবে না সৌদি সরকার। এসব টিকা হলো: ফাইজার বায়ো-এনটেক (২ ডোজ), অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা (২ ডোজ), মডার্না (২ ডোজ) ও জনসন অ্যান্ড জনসন (১ ডোজ)।
বাংলাদেশ থেকে যারা সৌদি আরবে যাবেন তারা এর যে কোনো একটি কোম্পানির টিকার ডোজ নিলে তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তবে টিকা নিলেও ভ্রমণের আগে (৭২ ঘণ্টার মধ্যে) অবশ্যই পিসিআর টেস্ট করে নেগেটিভ সনদ নিয়ে ভ্রমণ করতে হবে।
টিকার পূর্ণ ডোজ নেওয়া ছাড়া কোনো বাংলাদেশি অভিবাসী সৌদি আরবে প্রবেশ করলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে সাত দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। তবে ইকামাধারী অভিবাসী যারা সৌদি আরবে টিকা নিয়ে ছুটিতে দেশে রয়েছেন এবং যাদের তাওয়াক্কালনা অ্যাপে ইমিউন প্রদর্শন করছে তাদের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন প্রয়োজন হবে না। কিন্তু পিসিআর নেগেটিভ সার্টিফিকেট লাগবে।
প্রথম ডোজ টিকা নেয়ার ১৮০ দিন পর্যন্ত তাওয়াক্কালনা অ্যাপে ইমিউন প্রদর্শন করে। এ সময়ের মধ্যে ভ্রমণ করলে কোয়ারেন্টাইন প্রয়োজন হবে না। যারা প্রথমবারের মতো সৌদি আরব যাবেন তাদের জন্য সৌদি সরকার অনুমোদিত টিকা ভ্রমণের ১৪ দিনে আগে নেওয়া হলে এবং টিকা নেওয়ার সনদ থাকলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন প্রয়োজন হবে না।
ফাইজারের টিকা দিতে না পেরে বিক্ষোভ
এদিকে ফাইজারের টিকা দিতে না পেরে রাজধানীর একটি টিকাকেন্দ্রে বিক্ষোভ করেছেন সৌদি আরব ও কুয়েত প্রবাসীরা। গতকাল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে।
বিক্ষোভকারীরা টিকাদানে বিশৃঙ্খলা ও হয়রানির অভিযোগ করেন। ওই কেন্দ্রে প্রবাসীদের ফাইজারের টিকা দেয়ার কথা থাকলেও টিকা শেষ হয়ে যাওয়ায় তাদের মডার্নার টিকা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। এতে প্রবাসীরা বিক্ষোভ শুরু করেন।
এ সময় হাসপাতালের কর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে প্রবাসীদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। যদিও পরে কিছু প্রবাসী মডার্নার টিকা গ্রহণ করেন। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ফাইজারের মতো মডার্নার টিকাও কুয়েত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে স্বীকৃত।
বিক্ষোভকারী প্রবাসীরা বলেন, গত ৫ই জুলাই প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিদেশগামী কর্মীদের মধ্যে যারা সৌদি আরব ও কুয়েত যাবেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার-বায়োএনটেকের করোনা ভাইরাসের টিকা পাবেন।
আর যারা অন্য দেশে যাবেন, তারা চীনের সিনোফার্মের টিকা পাবেন। টিকা শুরুর দুই-তিন ঘণ্টা পর আনসার সদস্যরা ফাইজারের টিকার জন্য টাকা চান। এরই মধ্যে আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ফাইজারের টিকা শেষ হয়ে গেছে বলে ঘোষণা দেন।
‘কোভিশিল্ড’ টিকা নিলে ছাড় দেবে না য়ুরোপ
ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও টিকাপ্রস্তুতকারী সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা প্রতিষেধকটিকে ‘কোভিশিল্ড’ নামে তৈরি করেছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট। কিন্তু অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাকে ছাড়পত্র দিলেও কোভিশিল্ড নিয়ে আপত্তি তৈরি করছে খোদ ব্রিটেন। একটি রিপোর্টে জানা গেছে, ব্রিটেনের যেসব নাগরিক কোভিশিল্ড নিয়েছেন, তাদের য়ুরোপে পর্যটনে অনুমতি দেয়া হচ্ছে না।
সম্প্রতি য়ুরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর টিকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘য়ুরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি’ (ইএমএ) জানায়, তারা কোভিশিল্ডের জন্য বাণিজ্যিক ছাড়পত্রের আবেদন পায়নি। তাই তারা প্রতিষেধকটিকে জরুরি ভিত্তিতে ছাড়পত্রের অনুমোদন দিচ্ছে না।
ইইউ এই পর্যন্ত ছাড়পত্র দিয়েছে ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং জনসন অ্যান্ড জনসন-এর কোভিড প্রতিষেধককে। জার্মানির ‘কিওরভ্যাক’ এবং রাশিয়ার ‘স্পুটনিক ভি’, চীনের ‘সিনোভ্যাক’ নিয়ে আলোচনা চলছে।
সূত্র মতে, ব্রিটেনের টিকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা (এমএইচআরএ) আগে ছাড়পত্র দিয়েছিল কোভিশিল্ডকে। দেশটির পরিবহণমন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপস বলেছিলেন, যারা ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছেন, তাদের পর্যটনে বাধা দেয়া হবে না।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের মুখেও একই কথা শোনা যায়। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ভারতীয় সংস্করণটি নিয়েছেন, তাদের কোনও সমস্যা হবে না। কিন্তু রিপোর্টে এর অন্যথাই হতে দেখা যাচ্ছে।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
এ ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, প্রবাসীদের জন্য ফাইজারের টার্গেট ১ হাজার ২০০ টিকা সকালে শেষ হয়ে যায়। এ সময় প্রবাসীরা ফাইজারের টিকা নেয়ার জন্য হইচই শুরু করেন। তারা মডার্নার টিকা নিতে নারাজ।
অথচ ফাইজারের টিকা ও মডার্নার টিকা একই। এই সিদ্ধান্ত তো আমাদের না। আমরা তাদের বলেছি, মডার্নার টিকা নিলে প্রবাসীদের বিদেশে যেতে অসুবিধা হবে না। আনসার সদস্যদের টাকা দাবির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তদন্ত করে দেখা হবে। এমনটি কেউ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে, ফাইজার অথবা মডার্নার টিকা নিয়ে কুয়েত ও সৌদি আরব যেতে পারবেন বলে জানিয়েছেন প্রবাসী ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আহমেদ মনিরুছ সালেহীন। তিনি বলেন, কুয়েত ও সৌদি আরবে ফাইজার ও মডার্নার টিকার কথা বলেছে। ফাইজারের টিকা না নিলে যে কুয়েত ও সৌদি আরবে যেতে পারবে না বিষয়টি কিন্তু এমন নয়, মডার্নার টিকা নিলেও তারা সংশ্লিষ্ট দেশে যেতে পারবেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ