শিশু নির্যাতন জঘন্য অপরাধগুলোর মধ্যে অন্যতম। যদিও কেবল আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার নিরসন ঘটানো সম্ভব নয়, তবুও আইন প্রয়োগের কমতি এই অপরাধ প্রবণতাকে আস্কারা দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। এক প্রতিবেদনে এসেছে, গত বছর ১ হাজার ৫২১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে মাছ চুরির অভিযোগে শিশু নির্যাতনের ঘটনা, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে সামনে নিয়ে এসেছে।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় মাছ চুরির অপবাদে ৯ বছরের এক শিশুকে মধ্যযুগীয় কায়দায় গাছের সাথে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) নির্যাতনের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
এর আগে শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় উপজেলার মল্লিকপুরে এ ঘটনাটি ঘটে। নির্যাতিত শিশুটি স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিতে দেখা যায়, শিশুটিকে যে গাছে বেঁধে রেখে নির্যাতন করা হয় তার পাশেই আরেকটা গাছে গরু বেঁধে রাখা। এই বিষয়ে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার রায়।
শিশুটির বাবা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, “মাছ চুরির অপবাদে শিশুটিকে একটি গাছের সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে নির্যাতন চালান একই গ্রামের রমজান আলী বাসু।”
অভিযুক্ত রমজান আলী বাসু এ বিষয়ে জানান, “হাসি তামাশা করে তাকে বেঁধে দুইটা বাড়ি দিয়েছি। নির্যাতন করিনি।”
এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর তথ্য অনুযায়ী বিগত জানুয়ারী-এপ্রিল ২০২১ পর্যন্ত, মোট ৩৮৭ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং ২৪২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭-১২ বছরের ৮৮ জন শিশু এবং ৬ বছরের নিচে ৪১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
২০২০ সালে পরিচালিত আসক এর এক জরিপ প্রতিবেদনে অংশ নেয়া শিশুদের মধ্যে ৮২ জন ছেলে ও ৯৬ জন মেয়েশিশু ছিল। এই জরিপে দেখা যায়, ৮ শতাংশের বেশি মেয়েশিশু অনলাইনে যৌন শোষণ, হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে। সাইবার বুলিং ও যৌন আবেদনমূলক কনটেন্টের মুখোমুখি হয়েছে আরও প্রায় ৮ শতাংশ শিশু।
অনলাইনে ৩৬% মেয়ে শিশু বন্ধুদের যৌন নির্যাতনের শিকার। ২৩ শতাংশ মেয়ে শিশু যৌন কনটেন্টের মুখোমুখি হয়েছে। ৪৬ শতাংশ অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব পেয়েছে। ২৭ শতাংশের বেশি মেয়ে শিশু পরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ও আত্মীয় এবং ১৮ শতাংশ অপরিচিত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
এদিকে, আটটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের ‘শিশু পরিস্থিতি রিপোর্ট ২০২০ পত্রপত্রিকার পাতা থেকে’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে একহাজার ৫২১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে মেয়ে শিশু ১০৮৮ আর ছেলে শিশুর সংখ্যা ৪৩৩।
নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ৬২৬টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে মেয়ে শিশুর সংখ্যা ৬১৬ এবং ছেলে শিশুর ১০টি। নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে ১৪ শিশু।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীনা আনাম বলেন, ৮টি পত্রিকা থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করি। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের ঘটনাই আমরা দেখি। সব ঘটনা পত্রিকায় আসে না। তবু আমরা চেষ্টা করি। আমরা দুই বছরের তুলনা করে থাকি। এইবার করোনার এই সময়টি একটা ইউনিক সময়। স্কুল কলেজ সব বন্ধ ছিল। বাচ্চারা সব বাসায় বন্দিই ছিল। বাড়িতে থাকার পরও অনেক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এদিকে, শিশুর নির্যাতন প্রতিরোধ সম্পর্কিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি প্রতিবেদন ২০২০ অনুসারে, প্রতিবছর বিশ্বের অর্ধেক শিশু (প্রায় ১০০ কোটি) শারীরিক, যৌন এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার। এর ফলে তারা আহত তো হয়ই, কেউ কেউ প্রতিবন্ধী হয়ে যায়, কখনো কখনো শিশুদের মৃত্যুও ঘটে।
গত বছরের জুন মাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউনেসকো এবং শিশুর নির্যাতন অবসানে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি কর্তৃক প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বাংলাদেশসহ ১৫৫টি দেশে শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ ও সাড়াদানের সাতটি কৌশলসংবলিত ‘ইন্সপায়ার’র অগ্রগতি সম্পর্কে তথ্য আছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রায় সব দেশেই (৮৮ শতাংশ) নির্যাতন থেকে শিশুদের রক্ষার জন্য আইন রয়েছে, তবে অর্ধেকের কম দেশগুলোতে (৪৭ শতাংশ) আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অপরাধীদের খুব কমই বিচারের আওতায় আনা হয়; যার কারণে শিশু নির্যাতন ঘটেই চলেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখিত এক হিসাবে, জরিপের আগের মাসে বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছরের শতকরা ৮৯ ভাগ শিশুকে ‘শৃঙ্খলা’ বা কোনো কিছু শেখানোর নামে নির্যাতন করা হয়েছে।
আমাদের দেশে শিশুদের শাস্তি বেশির ভাগ মানুষের কাছেই গ্রহণযোগ্য। এর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা খুব কম। সব শিশুই নির্যাতনের ঝুঁকিতে আছে, তবে শিশুশ্রমিক, পথে বসবাসকারী শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুসহ অনেক শিশু তাদের অবস্থানের কারণে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকে।
বাংলাদেশে শিশু, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সমাজকল্যাণ ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাব সামগ্রিকভাবে শিশুর নির্যাতন মোকাবিলাকে কঠিন করে তুলেছে। তার সঙ্গে রয়েছে অপর্যাপ্ত পেশাদারি দক্ষতা এবং সীমিত বিনিয়োগ।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/২৪৪৫
আপনার মতামত জানানঃ