গত বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এখন অব্দি ৫২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। আনুমানিক বিকেল ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে আগুন লাগে। এর ঘন্টাখানিক পরেও ভেতরে আটকে পড়াদের রশি বা মই দিয়ে বের করে আনার কোনোরকম চেষ্টাই করেনি কর্তৃপক্ষ। এরচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, কলাপসিবল গেট বন্ধ করে রাখা ছিলো পুরোটা সময় জুড়েই।
ভেতরে আগুনের মধ্যে আটকে থাকা অসহায় মানুষেরা বের হবার জন্য আহাজারি করে যাচ্ছিল। ধোঁয়ায় ভরে যাওয়া ঘরে শ্বাস নিতে না পেরে বিভিন্ন তলা থেকে লাফ দিয়ে নিহত হয়েছেন কয়েকজন শ্রমিক, আহত হয়েছেন অনেকে। এখন পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারা ৫২ জনের দেহ আগুনে পুড়তে পুড়তে এতটাই জ্বলে গেছে যে, ডিএনএ টেস্ট ছাড়া তাদের পরিচয় শনাক্ত করাও সম্ভব হচ্ছে না। কারও কারও কেবল দেহাবশেষ পাওয়া গেছে। এখনও শেষ হয়নি ধ্বংসস্তুপ তল্লাশি করা।
অগ্নিকাণ্ডে এত মৃত্যুর কারণ
বৃহস্পতিবার আনুমানিক ৫টা থেকে সাড়ে ৫টার মধ্যে আগুন লাগার পর সময় পার হতে থাকে। অনেক সময় পার হয়ে গেলেও কর্তপক্ষ রশি বা মইয়ের ব্যবস্থা করেনি ভেতরে আটকে পড়া মানুষগুলোতে বের করে আনার জন্য। এদিকে ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেলে শ্বাস নেয়া আর সম্ভব হয়ে উঠছিলো না বলে শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ লাভ দিয়ে নিহত হন, কেউ কেউ এত উপর থেকে লাফ দিয়েও বেঁচে যান কোনোমতে।
এরচেয়েও সন্দেহজনক ঘটনা হলো কলাপসিবল গেইট বন্ধ করে রাখা। আগুন লাগার পরেও সজিব গ্রুপের কর্তৃপক্ষ কলাপসিবল গেইট খুলে দেয়নি যা বাহির দিক দিয়ে বন্ধ করা ছিলো, ফলসরূপ কারও দ্বারা স্বাভাবিকভাবে বের হয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এত ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের টিম পর্যাপ্ত দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারেনি বলেও অভিযোগ উঠেছে।
টাকা দিয়েই শোধ করা হচ্ছে প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ
আগুন লাগা একটি দুর্ঘটনা হলেও সেটার পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিকমত নেয়া হলে বেঁচে যেতে পারত অনেকগুলো প্রাণ। এই প্রাণ নেয়ার দায় কেবল টাকা দিয়েই শোধ করা যায়, এমন মনে করার ফলসরূপ মৃত্যু শ্রমিকদের প্রতিটি পরিবারকে ২ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে শ্রম কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে বলে শুক্রবার সন্ধ্যায় জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। আর আহত শ্রমিকদের ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।
এদিকে সজিব গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ আবুল হাসেম বলেন, ‘জীবনে বড় ভুল করেছি ইন্ডাস্ট্রি করে। ইন্ডাস্ট্রি করলে শ্রমিক থাকবে। শ্রমিক থাকলে কাজ হবে। কাজ হলে আগুন লাগতেই পারে। এর দায় কি আমার?’
অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনার জরিপ
সারাদেশে আগুনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সারাদেশে দেড় লাখ আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১ হাজার ৪৯০ জনের মৃত্যু এবং ৬ হাজার ৯৪১ জন দগ্ধ হয়েছেন। তবে শুধু ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ২২ হাজার ২৮৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ১৩৮ জন। দগ্ধ হন ১৪ হাজার ৯৩২ জন আর আগুনের ঘটনায় সম্পদ নষ্ট হয়েছে ২০৩ কোটি ৯২ লাখ ৭৪ হাজার ৩১৫ টাকার।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য বলছে, আগুনের ঘটনায় ২০০৯ সালে মারা যান ১১৮ জন, আহত হন ১ হাজার ৮৭ জন; ২০১০ সালে মৃত্যু ২৭১ জন, আহত ৭১৯ জন; ২০১১ সালে মৃত্যু ৩৬৫ জন, আহত ১ হাজার ৩৮৫ জন; ২০১২ সালে মৃত্যু ২১০ জন, আহত ৭৫৯ জন; ২০১৩ সালে মৃত্যু ১৬১ জন, আহত ১ হাজার ৩৮৫ জন; ২০১৪ সালে মৃত্যু ৭০ জন, আহত ২১০ জন; ২০১৫ সালে মৃত্যু ৬৮ জন, আহত ২১৬ জন; ২০১৬ সালে মৃত্যু ৫২ জন, আহত ২৪৭ জন; ২০১৭ সালে মৃত্যু ৪৫ জন, আহত ২৬৯ জন এবং ২০১৮ সালে মৃত্যু হয়েছে ১৩০ জনের এবং আহত হয়েছেন ৬৬৪ জন। এদিকে, ২০১৯ এই মৃত্যু ২ হাজার, ১৩৮ জন, আহত হয়েছেন ১৪ হাজার ৯৩২ জন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগুনের ঘটনা এভাবে বাড়ার পরও জনসচেতনতা বাড়েনি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন—ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশন আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবনসহ কল-কারখানাগুলোতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিতে সঠিক নজরদারি করছে না। আর এ কারণে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েই চলছে।
সূত্র মতে, দেশের বহুতল ভবন ও কল-কারখানাসহ বাণিজ্যিক ভবনগুলোর প্রায় ৯০ ভাগেই অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বেশির ভাগ ভবন পুরনো, তাই বর্তমানে সেগুলোতে প্রয়োজনীয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সংযোজন করাও কঠিন। তাছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের ফলেও আগুনের ঘটনা বাড়ছে।
এতগুলো শ্রমিকের প্রাণ যাওয়ার দায় কেবল টাকা ব্যয় করে উত্রে যেতে পারে পারে না কর্তৃপক্ষ। অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা না থাকা, আগুন লাগার পরেও রশি, মই দিয়ে সাহায্য না পাঠানো এবং কলাপসিবল গেট বন্ধ করে রাখার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/ডব্লিউজেএ/১৪২১
আপনার মতামত জানানঃ