একজন কবি জনগণের কথা বলবেন, সাধারণ মানুষের কথা বলবেন— এটাই স্বাভাবিক। যদি জনগণ ও মানুষের পক্ষে বলা কথা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায় তবে সেই দোষ হওয়ার কথা সরকারের, কবি’র নয়। কিন্তু কর্পোরেট নিয়ম ‘বস ইজ অলওয়েজ রাইট’ নীতিতে চলা সরকারের নিকট কোনো কথাই নিরাপদ নয়। আর যদি হয় মধ্যপ্রাচ্যের মত কোনো সরকার তখন একজন কবি’র অসহায়ত্ব খুব স্পষ্ট করেই ধরা দেয়।
কুয়েতের বিশিষ্ট কবি জামাল আল–সায়ের কুয়েত সরকারের দুর্নীতি বিষয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই টুইটারে নানা ধরনের কবিতা পোস্ট করছিলেন। সরাসরি দেশের আমিরেরও নিন্দা করেন তিনি৷ বলেন যে, কুয়েতের ‘অসহনীয়’ অবস্থার জন্য আমির দায়ী ও তার সরকার ‘সংবিধানের অবমাননা’ করেছে৷তার এই বক্তব্যই যেন কাল হয়ে দাঁড়াল। কেননা, কুয়েতের রাজনীতিতে গণ আন্দোলন ও সমালোচনার সংস্কৃতি থাকলেও আমিরের নিন্দা বা অসম্মানকে কড়া নজরে দেখা হয়৷
সংবিধান অনুযায়ী, কুয়েতের সংসদ সদস্যদের সরকার ও তার মন্ত্রীদের প্রশ্ন করার অধিকার থাকলেও দেশটির আমির শেখ নাওয়াফ আল আহমাদ আল সাবাহ-এর অবস্থান এসব কিছুর ওপরে। আর এজন্যই কবিকে গ্রেপ্তার করে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। খবর ডয়েচে ভেলে, রয়টার্স, গালফ নিউজ
গত সোমবার গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে কবি জামাল আল সায়ের নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মানহানির দুটি ধারায় মামলা করেছে কুয়েত কর্তৃপক্ষ।
গত বুধবার কবির পরিবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এরপর থেকেই দেশটির মানবাধিকার কর্মী ও নেতারা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
তার ভাইপো ও আইনজীবী মুহানান্দ আল–সায়ের বলেছেন, জামাল আল–সায়েরের বিরুদ্ধে কুয়েতের আমিরকে অপমান; ভুয়া খবর ছড়ানো, যাতে রাষ্ট্রের সম্মান ক্ষুণ্ন হতে পারে এবং মুঠোফোনের অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মুহানান্দ আরও বলেন, গত সোমবার রাস্তায় তিনটি পুলিশের গাড়ি জামাল আল–সায়েরের পথ আটকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বিষয়ে এখনো দেশটির আমির শেখ নাওয়াফ আল-আহমেদ আল-সাবাহর কথাই চূড়ান্ত। কিন্তু কুয়েতই একমাত্র দেশ, যেখানে নির্বাচিত পার্লামেন্টকে আইন ও মন্ত্রীদের বিষয়ে ভোট দেওয়ার ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে।
পার্লামেন্ট থেকে দেশটির প্রধামন্ত্রী রাজপরিবারের সদস্য শেখ সাবাহ আল-খালিদ আল-সাবাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাতে সফলতা আসেনি।
গত ২৮ জুন জামাল আল-সায়ের কুয়েতের আমির ও যুবরাজ বরাবর টুইট করে বলেন, ‘পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আপনারাই পার্লামেন্ট ও জনগণের ইচ্ছাকে অবমাননা করে সরকারকে সংবিধান লঙ্ঘন ও বাধাগ্রস্ত করার সুযোগ দিয়েছেন।’
এদিকে জামাল আল–সায়েরকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটি দেশটির সংসদ সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
দেশটির বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতা আবদুল আজিজ আল-সাকাবি বলেন, ‘সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, এমন কোনো পুলিশি রাজ্যে পরিণত হব না আমরা। স্বাধীনতা খর্ব, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের বিরুদ্ধে গিয়ে মাফিয়া ও গ্যাং স্টাইল অনুসরণের বিষয়টিও আমরা গ্রহণ করব না।’
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায় যে, কবি তার বিরুদ্ধে ওঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷ এবিষয়ে কুয়েতের কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্তব্যও পাওয়া যায়নি৷
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলের খবরে বলা হয়, কবি জামাল আল সায়ের কুয়েতে জনপ্রিয় হয়েছেন দেশপ্রেম বিষয়ে বেশ কিছু কবিতা লিখে৷ তার পাশে এস দাঁড়িয়েছেন দেশটির বহু অধিকারকর্মী ও কয়েকজন রাজনীতিকও৷ কুয়েতের টুইটার একাউন্টগুলিতে মঙ্গলবারে ট্রেন্ডিং ছিল ‘ফ্রি জামাল আল সায়ের’ হ্যাশট্যাগ৷
সরকারের বিরোধীপক্ষের আইনজীবী খালেদ আল ওতাইবি বলেন, ‘কুয়েত একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্র৷ সেখানে এই ধরনের স্বৈরাচারী আচরণ ও সমালোচনা বন্ধ করার রাজনীতি আমরা বরদাস্ত করব না৷’
চলতি বছরে এর আগেও কুয়েতের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ওঠে লেখক, বুদ্ধিজীবীদের গ্রেপ্তার করে জেরা করার অভিযোগ৷ মুহান্নাদ আল সায়ের একটি টুইট করে বলেন, ‘জামাল আল সায়েরের গ্রেপ্তার আমাদের দেখায় কীভাবে অধিকার ও স্বাধীনতার রক্তক্ষরণ হচ্ছে আমাদের দেশে৷ এই দেশ, যে এক সময় তার স্বাধীনতার উদযাপন করত, এখন তার সন্তানদের স্বাধীনতা হরণ করছে৷’
এসডব্লিউ/কেএইচ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ