২০২০ সালে চীনের পার্লামেন্টে জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করে। নতুন আইনে রাষ্ট্রদ্রোহ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজকর্ম নিষিদ্ধ করার জন্য কড়া পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে হংকংয়ে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি প্রতিষ্ঠার উল্লেখ রয়েছে।
চীন ও হংকংবাসীর মৌলিক স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে চীন দাবি করছে। উল্টোদিকে আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, এই নতুন আইনটি হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতায় শেষ পেরেক পুঁতে দেবে।
১৯৯৭ সাল পর্যন্ত হংকং ছিল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে। বিশেষ চুক্তি করে ব্রিটিশ সরকার তা চীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়। শর্ত ছিল, আগামী ৫০ বছর হংকংবাসী নির্দিষ্ট কিছু স্বাধীনতা ভোগ করবে, যা চীনের মূল ভূখণ্ডের মানুষ পারে না। হংকংয়ের নাগরিকদের বাক্স্বাধীনতা, প্রতিবাদের স্বাধীনতা রয়েছে। তাদের বিচারব্যাবস্থা সম্পূর্ণ স্বাধীন।
আইন অনুযায়ী, চীন রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা, সরকারের বিরোধিতা, সন্ত্রাসবাদ, বিদেশি শক্তির সঙ্গে আঁতাত অপরাধ বলে গণ্য হবে। হংকং শহরে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার জন্য নতুন দফতর তৈরি হবে। হংকংয়ের স্কুলে জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যা কিছু পড়ানো হবে, তাতেও নজরদারি চালাবে বেইজিং। আইন মানা হচ্ছে কিনা, তা দেখার জন্য শহরে জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন বসানো হয়েছে। এর মাথায় আছেন বেইজিংয়ের নিযুক্ত উপদেষ্টা।
সেই আইনের বিরুদ্ধে হংকংয়ে বিক্ষোভ চলছে আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে। সেই বিক্ষোভের খবর ও নিবন্ধ ধারাবাহিক ছেপে যাওয়ায় হংকংয়ের প্রখ্যাত ট্যাবলয়েড পত্রিকা অ্যাপল ডেইলি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। গ্রেপ্তার করা হয়েছে পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদককে।
২০১৯ সাল থেকে চলমান বিক্ষোভে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে চীন নিয়ন্ত্রিত হংকং সরকার,যার মধ্যে ১২৮ জন সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদও রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় নিরাপত্তা আইনের বিরোধীদের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয় তথ্য প্রকাশ করছে একটি পক্ষ। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাদের হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন বিক্ষুব্ধ নাগরিকরা।
এদিকে হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে সেবা বন্ধের হুমকি দিয়েছে গুগল, ফেসবুক, টুইটার, অ্যাপল, লিঙ্কডিনসহ টেক জায়ান্টরা।
দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৫ জুন এশিয়া ইন্টারনেট কোয়ালিশনের পক্ষ থেকে হংকংয়ের তথ্য নিরাপত্তা বিষয়ক কমিশনার এইডা চু লাই-লিং কে এক চিঠিতে এই কথা জানানো হয়েছে।
এশিয়া ইন্টারনেট কোয়ালিশনের পরিচালক জেফ পেইনের ছয় পাতার চিঠিতে বলা হয়েছে, হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা তথা বাক স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্থ করবে। এই আইনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হলে হংকংয়ের নাগরিকরা বৈশ্বিক যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
টেক জায়ান্টরা হংকংয়ে বিনিয়োগ ও পরিষেবা বন্ধ করে দিলে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। এতে হংকংয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপিত হতে পারে আশঙ্কা করছেন তারা।
এদিকে প্রযুক্তিভিত্তিক সেবাদানকারী একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জাতীয় ও সাইবার নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে চীনা সাইবার নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বিশেষত, নিউইয়র্ক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে তৎপর হয়ে উঠেছে চীন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, সম্প্রতি চাইনিজ মোবাইল অ্যাপলিকেশন স্টোর থেকে দেশের বৃহৎ রাইড-শেয়ারিং এপ ডিডি চুশিং সরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
সোমবার চীনের সাইবার নজরদারি প্রশাসন দ্য সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (সিএসি) অনলাইনভিত্তিক নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান বস জিপিন এবং ট্রাক ও পিকআপ পরিবহন সেবাদানকারী অ্যাপ ফুল ট্রাক অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনার ঘোষণা দেয়।
তদন্ত চলাকালে নতুন কোনো ব্যবহারকারী এসব অ্যাপে রেজিস্ট্রেশন করতে পারবেন না।
প্রযুক্তিভিত্তিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে চীনের জাতীয় নিরাপত্তা ও সাইবার নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে সিএসি। তবে, তারা বিস্তারিত কোনো তথ্য প্রদান করেনি।
ডিডি এবং অন্যান্য অ্যাপের বিরুদ্ধে তদন্তের পর দেশের প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে চীনের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সাইবার নিরাপত্তা বিধিমালাগুলো দীর্ঘ সময় অব্যবহৃত থাকার পর নতুন করে টেক প্ল্যাটফর্মগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা শুরু হয়েছে।
এর আগে, প্রযুক্তি সম্রাট ও বিলিয়নিয়ার জ্যাক মার প্রধান দুই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আলিবাবা ও অ্যান্ট গ্রুপের লাগাম টেনে ধরে চীনের আর্থিক এবং প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ই-কমার্স গ্রুপ মেটুয়ানের বিরুদ্ধের একই ধরনের অবস্থান নেওয়া হয়।
চীনের এই ধরপাকড়ের কারণে সোমবার এশিয়ার বাজারে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। ডিডির পিছে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ করে আসছে জাপানি প্রতিষ্ঠান সফটব্যাংকের ভিশন ফান্ড। সোমবার হংকংয়ে সফটব্যাংকের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার পতন হয়।
অন্যদিকে, আলিবাবা ও টেনসেন্টের শেয়ার পতন হয়েছে যথাক্রমে ২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
শুক্রবার নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নাম লেখানোর মাত্র দুই দিনের মাথায় ডিডির শেয়ার ৫ দশমিক ৩ শতাংশ পর্যন্ত নেমে আসে।
সিএসির দাবি, তারা ১ জুন প্রণীত নতুন সাইবার স্পেস বিধিমালার অধীনে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি জোরদার করছে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে স্পর্শকাতর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি পরিচালনাকারীদের তত্ত্বাবধানের জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চীনের জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় ট্যাবলয়েড পত্রিকা দ্য গ্লোবাল টাইমস জানিয়েছে, ডিডির আন্তর্জাতিক অংশীদারদের হাতে রয়েছে উবারসহ অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর অ্যাপ। সুতরাং, এসব অ্যাপ ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুর একটি বিষয়।
শুক্রবার ডিডির বিরুদ্ধে তদন্তের ঘোষণা প্রদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সিএসির এই নতুন অভিযান। প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন ব্যবহারকারী ও ড্রাইভারের রেজিস্ট্রেশন বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
রবিবার, চীনা প্লে-স্টোর থেকে অ্যাপটি সরানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।
২০২১ সালে নিউইয়র্কে ৩৪টি চীনা প্রতিষ্ঠান রেকর্ড সংখ্যক ১২.৪ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহের পরই শুরু হলো এই নতুন অভিযান।
তবে, দুই-তৃতীয়াংশ চীনা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার মূল্য আইপিও থেকে নেমে এসেছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ