ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট। ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসিকে ‘জল্লাদ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে রাইসি নির্বাচিত হওয়ায় ইরানের পরমাণু চুক্তি ফের কার্যকর করার আগে পরাশক্তি দেশগুলোকে এখনই ‘নড়েচড়ে বসারও’ আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
গত সপ্তাহে ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর রোববার (২০ জুন) জেরুজালেমে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে নাফতালি বেনেট একথা বলেন।
ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইব্রাহিম রাইসি ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানে এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। মাত্র ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ইব্রাহিম রাইসি মোট ২ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার ৪ ভোট পেয়েছেন।
১৯৮৮ সালে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে বিচারবহির্ভূত হত্যায় ইরানের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির ভূমিকার পুরনো অভিযোগ রয়েছে। সেই সময়ের এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কখনই স্বীকার করে না ইরান। এছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে নিজের ভূমিকার অভিযোগের ব্যাপারেও কখনও জনসম্মুখে মন্তব্য করেননি রাইসিও।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের শুরুর বছরগুলোতে সশস্ত্র বিরোধীদের নির্মূলে সংক্ষিপ্ত সময়ের বিচারে হাজারও মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় ইরানে। দেশটির কিছু ধর্মীয় নেতা বলেছেন, বিচারকার্য সুষ্ঠু ছিল। ওই বিচারকার্যের প্রশংসা করেন তারা। সেই সময় দেশটির বিচার বিভাগের বিচারক ছিলেন রাইসি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তেহরানের ফাঁসিদাতাকে বেছে নিয়েছেন, যিনি বহুদিন ধরে ইরান ও বিশ্বজুড়ে হাজারও নিরীহ ইরানি নাগরিকের ফাঁসির হুকুমদাতা হিসেবে পরিচিত।
নাফতালি বলেন, ‘এই লোক (রাইসি) একজন খুনি, গণহত্যাকারী। এমন একজন নিষ্ঠুর জল্লাদের হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র তুলে দেওয়া কখনই উচিত নয়। এতে তিনি হাজার নয়, লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করতে সক্ষম হবেন।’
প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাইসির জয়কে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরার আগে বিশ্বশক্তির জন্য চূড়ান্ত ‘জাগরণ’ বলে মন্তব্য করেছেন নাফতালি।
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তি ফের কার্যকর করতে রোববার থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অলোচনা পরোক্ষ শুরু করেছে ইরান ও পরাশক্তি দেশগুলো। গত এপ্রিল মাস থেকে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যস্ততায় পরমাণু চুক্তিতে ফেরার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইরানি ও মার্কিন কূটনীতিকরা।
তবে ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর এধরনের যেকোনো চুক্তির ঘোর বিরোধী ইসরায়েল। নেতানিয়াহুর বিদায়ের পর নতুন সরকার দায়িত্ব নিলেও দেশটির এই মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
রোববার বেনেট বলেন, ‘ইরানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাইসি নির্বাচিত হওয়ায় এই চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে পরাশক্তি দেশগুলোকে ভেবে দেখতে হবে। ইরানের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার এটাই শেষ সময়।’
এসময় ইরানের ক্ষমতাসীনদের হত্যাকারী, গণহত্যাকারী বলেও আখ্যায়িত করেন তিনি।
আগামী আগস্টে রুহানির কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা নেবেন রাইসি। তার আগেই পারমাণবিক চুক্তিতে ফেরা ও তেহরানের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে ইরানের চলমান আলোচনার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে ইরান। চুক্তি মেনে দেশটি পারমাণবিক কার্যক্রম থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়। বিনিময়ে তেহরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে প্রত্যাহারের কথা জানায় পশ্চিমা দেশগুলো।
কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় ২০১৮ সালে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী উল্লেখ করে তিনি এ চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন ইরানের ওপর।
তবে ট্রাম্পের বিদায়ের পর পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওই সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। ফলে আলোচনারও পথ সুগম হয়েছে, যাতে আশাবাদী হয়েছে ইরান।
মুখ থুবড়েপড়া সেই পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে নতুন করে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। আর সেই চুক্তির বিষয়েই সবাইকে সতর্ক করেছেন ইসরায়েলের নতুন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট।
উল্লেখ্য, ইরান ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। দুইটি দেশ সরাসরি কোনও সংঘাতে না জড়ালেও পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়ে থাকে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেন বরাবরই ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিলুপ্তির কথা বলে আসছেন। ২০১৮ সালে তিনি ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের ক্যান্সার আক্রান্ত টিউমার আাখ্যা দিয়ে এই অঞ্চল থেকে তাকে সরিয়ে ফেলার আহ্বান জানান। অন্যদিকে ইসরায়েল ইরানকে বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। তাদের দাবি তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে।
হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল ইরানের পরমাণু কেন্দ্র
কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই জরুরিভিত্তিতে ইরানের একমাত্র পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শনিবার (১৯ জুন) বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য কেন্দ্রটিতে কাজ বন্ধ হয়ে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, ‘কারিগরি ত্রুটির’ কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে পরমাণু কেন্দ্রটি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, শনিবার দেশের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলেও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি ইরানের সরকার।
তবে পরমাণু কেন্দ্র বন্ধের কারণ নিয়ে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংস্থার কর্মকর্তা গোলাম আলী রাকশানিমেহের জানিয়েছেন, বৈদ্যুতিক সমস্যার কারণে শনিবার বুশেহর পরমাণু কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে এবং তা ‘আগামী তিন-চারদিন’ বন্ধ থাকবে।
তিনি এর বেশি আর কিছু জানাননি। তবে বুশেহর শহরের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত এই পরমাণু কেন্দ্রটি এবারই প্রথমবারের মতো আচমকা বন্ধ হয়ে গেল।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দর নগরী বুশেহরে ১৯৭০ সালে এই পরমাণু কেন্দ্রটি তৈরির কাজ শুরু করে ইরান। রাশিয়ার সাহায্যে কেন্দ্রটি তৈরির কাজ শুরু হয়। প্রায় ৪০ বছর পর ২০১১ সালে পরমাণু কেন্দ্রটি কাজ করতে শুরু করে। সেসময় প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম রাশিয়া থেকে নিয়ে আসা হতো। এছাড়াও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে দেশটিকে রাশিয়া বরাবরই সাহায্য করে আসছে।
তবে ২০১৫ সালে বিশ্বের ছয় পরাশক্তির সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর করে ইরান। এর ফলে পামাণবিক বোমা প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম মজুতের ক্ষেত্রে রাশ টানতে বাধ্য হয় রুহানির প্রশাসন। এছাড়া ইরান যাতে পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করে, সে দিকেও নজর রাখে জাতিসংঘ।
কিন্তু ২০১৮ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ত্রুটিপূর্ণ’, ‘একপেশে’, ‘এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই’ অভিযোগ তুলে চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে যান। যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে যাওয়ার পর চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলার ব্যাপারে ইরানও উদাসীন হয়ে পড়ে। তারপর থেকেই ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তুমুল টানাপোড়েন শুরু হয়। এমনকি রাশিয়া থেকে সাহায্য পাওয়াও বন্ধ হয়ে যায় দেশটির।
চলতি বছরের শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে ইরান হুমকি দেয় যে, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা না তুললে ইউরেনিয়ামের মজুত ফের বাড়ানো হবে। সে অনুযায়ী আগের চেয়ে ইউরেনিয়ামের মজুত কয়েক গুণ বাড়িয়েছে তেহরান। এছাড়া জাতিসংঘকেও পরমাণু কেন্দ্রের তথ্য দিচ্ছে না দেশটি।
এদিকে ইরানে পরমাণু কেন্দ্র হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ)। অবশ্য তেহরান বরাবরই বলে আসছে যে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। তারপরও পরমাণু কেন্দ্রে সর্বশেষ এই ঘটনা ইরানকে কিছুটা হলেও পিছিয়ে দিতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৭
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ