আকস্মিক বন্যায় বিপর্যস্ত দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভুটান এবং নেপাল। বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই গত তিনদিন ধরে দেশে ভারী বর্ষণ হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই। বন্যার কারণে ভুটানে এ পর্যন্ত দশজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। অন্যদিকে নেপালে ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যায় সাতজন নিখোঁজ রয়েছে। খবর রয়টার্স
প্রাণহাণি ছাড়াও বাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে গেছে ভুটানের বিস্তীর্ণ এলাকা। এতে বিধ্বস্ত হয়েছে বহু বাড়িঘর। ক্ষতির মুখে পড়েছে ফসলের ক্ষেত। রাজধানী থিম্পু থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের লয়ার কাছের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে অনেকেই। কিন্তু সেই আশ্রয় কেন্দ্রও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। আটকেপড়াদের উদ্ধারে হেলিকপ্টার নিয়ে কাজ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।
ভুটানে গ্রামবাসীরা কর্ডেসেপ নামক একটি ফাঙ্গাস সংগ্রহ করছিল। ঘুমিয়ে থাকার সময় মধ্যরাতে হঠাৎ বন্যার পানি সেখানে চলে আসে। তাদের ক্যাম্পটি ছিল রাজধানী থিম্পু থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে লয়ার শহরতলির কাছাকাছি। বন্যার পানিতে সেটি পুরোপুরি ভেসে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা এই মর্মান্তিক ঘটনার কথা জেনেছি যে কর্ডেসেপ সংগ্রহকারীদের একটি দলকে (বন্যা) আঘাত করেছে, আজ আমাদের হৃদয় লয়ারবাসীদের সঙ্গে রয়েছে।’
আহতদের উদ্ধারে দুটি হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া সামরিক বাহিনীর উদ্ধারকারীরা ঘটনাস্থলের দিকে যাত্রা করেছেন। কাছাকাছি রাস্তা থেকে প্রায় ১১ ঘণ্টা পেয়ে হেঁটে সেখানে পৌঁছাতে হবে।
ভুটান ও নেপালের গ্রামবাসীরা প্রতি বছর কর্ডিসেপ সংগ্রহ করতে পাহাড়ি অঞ্চলে যায়। এই ফাঙ্গাসে ওষধি গুণাগুণ রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
ভুটানি সংবাদপত্রে বলা হয়েছে, গ্রামবাসীদের ওই ক্যাম্পটি দুটি পাহাড়ের মাঝখানে একটি ছড়ার পাশে স্থাপন করা হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ছড়ায় যখন বন্যার পানি আসে তখন ক্যাম্পটি পানিতে ভেসে গেছে।
অন্যদিকে নেপালেও ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। ভারী বর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যায় দেশটিতে এখন পর্যন্ত অন্তত্য সাতজন নিখোঁজ রয়েছে। চীনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তিব্বত অঞ্চলের সীমান্তবর্তী নেপালের সিন্ধুপালচক জেলায় মঙ্গলবার (১৫ জুন) মধ্যরাতের বন্যায় বেশকয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন। মিলামছি নদীর পানিতে আশেপাশের এলাকা তলিয়ে গেছে।
নেপালের সিন্ধুপালচোক জেলায় রাতভর ভারি বর্ষণের ফলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় সাতজন নিখোঁজ হয়েছেন। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা দিল কুমার তামাং এ তথ্য জানিয়েছেন। বন্যায় মেলামচি নদীর পানি এসে বেশ কিছু ঘরবাড়ি প্লাবিত করেছে।
নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা দিল কুমার তামাং জানান, চীনের তিব্বত অঞ্চলের সীমান্তবর্তী সিন্ধুপালচক জেলায় রাতভর বৃষ্টির পর মেলামচি নদীতে দেখা দেওয়া হঠাৎ বন্যায় সাতজন নিখোঁজ হয়েছেন। বন্যায় ওই এলাকায় বহু ঘরবাড়ি ডুবে গেছে ।
তামাং বলেছেন, আমরা ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। বর্ষাকাল শুরু হতেই গত তিনদিন ধরে নেপাল ও ভুটানে প্রবল বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
বন্যায় ওই এলাকায় বহু ঘরবাড়ি ডুবে গেছে এবং তারা ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করছেন বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মেলামচি থেকে বেশ কয়েকজন লোক তাদের তল্পিতল্পাসহ উঁচু এলাকায় চলে গিয়েছিলেন, তারা পরিত্যাক্ত বাড়িগুলোতে আটকা পড়ার পর সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো তাদের উদ্ধার করেছে।
নেপালের কর্তৃপক্ষগুলো দেশটির নারায়নি নদীর তীরে বসবাসরত লোকজনকে সতর্ক থাকতে বলেছে কারণ নদীটির পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে।
মৌসুমি বায়ুর প্রভাব শুরু হওয়ার পর থেকে গত তিন দিন ধরে নেপাল ও ভুটানে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে।
ভারত, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় মোটামুটি জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বর্ষাকাল ধরা হয়। এ সময় মৌসুমি বায়ু যে বিপুল বৃষ্টি নিয়ে আসে, তা এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বৃষ্টি পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ মানুষের জীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। সময়মতো বৃষ্টি যেমন ফসল উৎপাদন বাড়ায়, তেমনি আবার অসময়ের অতিবর্ষণ ফসল ধ্বংসও করে। অতিবৃষ্টি নিয়ে আসে বন্যা, কেড়ে নেয় প্রাণ, ধ্বংস করে লোকালয়, ছড়িয়ে দেয় দূষণ।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা সম্প্রতি নতুন এক গবেষণায় দেখেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় বর্ষা মৌসুমে আরও বেশি বৃষ্টিপাত হবে এবং তা আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
জলবায়ুর পরিবর্তন যে বর্ষাকালকে বদলে দিচ্ছে, বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই তা বুঝতে পারছিলেন। কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করে করা আগের গবেষণাগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছিল যে, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়ায় তাপমাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে গরম আবহাওয়ায় বাড়তি আর্দ্রতা গ্রীষ্ম ও বর্ষাকে করে তুলেছে আরও বেশি বৃষ্টিপ্রবণ। এতে মাঝেমধ্যে হচ্ছে অতিবর্ষণ, কোনো পূর্বাভাস সেখানে টিকছে না।
সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত নতুন একটি গবেষণা প্রতিবেদন বিজ্ঞানীদের ওই ধারণার পক্ষেই নতুন প্রমাণ হাজির করেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। গত ১০ লাখ বছরে জলবায়ু কীভাবে বদলেছে, সেই তথ্য বিশ্নেষণ করে বিজ্ঞানীরা এ গবেষণায় ধারণা দিতে চেয়েছেন যে, কেমন হতে পারে আগামী দিনের বর্ষাকাল।
নতুন এই গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বর্ষার এই মেজাজ বদলে পুরো অঞ্চলের চেহারা আর ইতিহাসই বদলে যেতে পারে। এ গবেষণার জন্য ১০ লাখ বছরের জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য বিজ্ঞানীরা কীভাবে পেলেন? না, টাইম মেশিন তাদের নেই। তারা কাজ করেছেন কাদা নিয়ে। প্রতি বর্ষায় পুরো ভারতবর্ষ ধুয়ে বিপুল পলি নিয়ে বৃষ্টির পানি পৌঁছায় বঙ্গোপসাগর আর ভারত মহাসাগরে। সাগরের ভূস্তর খনন করে বিজ্ঞানীরা সেই নমুনা সংগ্রহ করেছেন।
এ বৃষ্টিপাত বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক–পঞ্চমাংশ লোকের জীবনে প্রভাব ফেলে, ফসলহানি ঘটায়, মারাত্মক বন্যার সৃষ্টি করে এবং প্রাণহানি ঘটানোর পাশাপাশি দূষণ বাড়ায়। নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট পরিবর্তন এ অঞ্চল এবং এর ইতিহাসকে নতুন আকার দিতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০২
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ