গত বছর মহামারির মধ্যেই দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ সময়ে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের আয় রোজগার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের জীবনমান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণবিষয়ক বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) বুধবার(১৬ জুন) প্রকাশিত বার্ষিক জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এ উপলক্ষে আয়োজিত ভার্চুয়াল সভায় উপস্থিত ছিলেন ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান, সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া।
প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকায় ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের মধ্যে থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা-সার্ভিসের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ভোক্তার ঝুলিতে যেসব পণ্য ও সেবা রয়েছে সেগুলোকে পরিবারের মোট ব্যয়ের সঙ্গে তুলনা করে পণ্য বা সেবার ওজনের ভিত্তিতে জীবনযাত্রা ব্যয়ের হিসাব করা হয়েছে। তবে এই হিসাবে শিক্ষা, চিকিৎসা ও প্রকৃত যাতায়াত ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ ও পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ। এর আগে ২০১৯ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক শূন্য শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।
এ বিষয়ে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, স্পষ্টতই বিগত তিন বছরের মধ্যে ২০২০ সালে রাজধানীতে জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেড়েছে। অন্যদিকে এ সময়ে করোনা মহামারির প্রভাবে নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত মানুষের আয় রোজগার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ২০২০ সালে নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের জীবনমান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বেশ কিছু পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। ক্যাব মনে করে, ২০২০ সালে চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বছরের শেষে আমন ধানের ভরা মৌসুমে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি থেমে থাকেনি। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে চালের গড় মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। অন্যদিকে দেশি ও আমদানি করা ডালের দাম গড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ এবং শাক-সবজির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে গড়ে ৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
এছাড়া ওয়াসার পানি প্রতি হাজার লিটারে দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। আবাসিকে বিদ্যুতের গড় মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ০৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক বিদ্যুতে মূল্য বেড়েছে গড়ে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
বিপরীত দিকে ঢাকায় বসবাসরত নিন্ম ও নিন্ম-মধ্যবিত্তের গড় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফ্ল্যাট বাসায় ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, বস্তিতে ঘর ভাড়া বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং মেসের ৮ সিট বিশিষ্ট রুমের ভাড়া বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। অন্যদিকে সাধারণ শাড়ি কাপড়ের দাম বেড়েছে গড়ে ৯ শতাংশেরও বেশি।
পণ্য ও সেবার মূল্য অব্যাহত বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় লাগামহীন হয়ে পড়া ঠেকাতে ক্যাব সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তার স্বার্থ সার্বিকভাবে দেখা এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে সমন্বয় করার জন্য একক কোনো মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে নেই। সরকার প্রতিনিয়ত নানা সিদ্ধান্ত নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের সিদ্ধান্ত ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে তা বিবেচনায় আসে না।
এই সংকট এড়িয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে গোলাম রহমান ১৫ থেকে ২০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব অর্পণ করে দেশে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় বা বিভাগ গঠন করার পরামর্শ দেন। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বিজনেস অ্যাফেয়ার্স গ্যাস ও কনজ্যুমারস অ্যাফেয়ার্স নামে দুটি আলাদা বিভাগ খোলার পক্ষে তিনি।
গোলাম রহমান বলেন, এই বিভাগ বা মন্ত্রণালয় ভোক্তা-স্বার্থ বিবেচনার উদ্দেশ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভোক্তা-স্বার্থের সমন্বয়সাধনও সহজ হবে; ভোক্তাদের কল্যাণ-অকল্যাণের দিকগুলো তুলে ধরবে।
তিনি বলেন, স্বতন্ত্র বিভাগ বা মন্ত্রণালয় ভোক্তা-স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সমন্বয় করার লক্ষ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমে সমন্বয় করবে। পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন, আমদানি-রপ্তানির সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করবে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে যাতে দরিদ্র, স্বল্প-আয় এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের ভোক্তারা বঞ্চিত না হন, সে লক্ষ্য রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
একদিকে আয়-রোজগার হ্রাস, আবার অন্যদিকে নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।
গোলাম রহমান বলেন, পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য অনুসারে, দেশে দরিদ্রের সংখ্যা বেড়েছে ২৯ শতাংশ। তবে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার গবেষণা মতে, এই হার ৪০ শতাংশ বা তারও অধিক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে ক্যাব সভাপতি আরও বলেন , মহামারিতে পারিবারিক মাসিক আয় ৪ হাজার টাকার কাছাকাছি পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আয় যেভাবে বাড়ছে, তার তুলনায় ব্যয় বাড়ছে তীব্রগতিতে। নিম্নবিত্তের মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বিভিন্ন সরকারি সুবিধা পেলেও বাড়তি ব্যয়ের চাপে পিষ্ট মধ্যবিত্তরা। জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে তাদের নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
তারা বলেন, শাকসবজি থেকে শুরু করে সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম লাগামহীন। একইভাবে বাড়ি ভাড়া, জ্বালানি ব্যয় বেড়েছে। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ ও চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়েছে। কিন্তু ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আয় বাড়ছে না। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমছে।
ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি অরাজনৈতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও অলাভজনক জাতীয় প্রতিষ্ঠান হলো ক্যাব। প্রতিবছরের শুরুতে আগের বছরে জীবনযাত্রার ব্যয় ও ভোক্তা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে তারা প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। তবে করোনার কারণে এবার প্রতিবেদন প্রকাশে প্রায় ছয় মাস দেরি হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৩৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ