প্রাচীন অ্যাসিরিও সভ্যতায় প্রথম মারমেইড বা মৎস্যকন্যাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। ওই সময়ের প্রচলিত গল্প অনুযায়ী দেবী অ্যাটারগেটিস নাকি একবার ভুল করে তার এক মানুষ বন্ধুকে হত্যা করে ফেলেন। আর তারপরই তিনি দুঃখে এবং লজ্জায় দেবী থেকে পরিণত হন মৎস্যকন্যায়। প্রাচীন এই সভ্যতার অনেক নিদর্শনে তাদের এই বিশ্বাসের প্রতিফলন পাওয়া গেছে। পাহাড়ের গুহায় তাদের আঁকা ছবিতে দেখা গেছে মারমেইডরা সাগরে ভেসে যাচ্ছে আর মানুষ তাদের দিকে বর্শা ছুঁড়ে মারছে। এছাড়া গ্রীক সভ্যতায়ও মারমেইডের কথা উল্লেখ আছে। তবে বাস্তবে এদের অস্তিত্ব নিয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। আছে বিভ্রান্তি। আছে হাওয়ায় উড়ে বেড়ানো কিছু গল্প।
তবে ২০০০ সালে সম্প্রচারিত ‘মারমেইডস: দ্য বডি ফাউন্ড’ সিরিজ এনিমেল প্লানেটের ইতিহাসের সবথেকে জনপ্রিয় শো। যদি কোন বাস্তবভিত্তিক প্রমাণ নেই, তবু এই শো ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এনিমেল প্লানেট তাদের সিরিজে কিছু প্রমাণ দিয়েছিল, যা পরবর্তীতে অনেকেই মিথ্যা বলে জানায়। এনিমেল প্লানেট দাবি করে মারমেইড বা মৎস্যকন্যা বাস্তবে আছে। ন্যাশনাল ওশান এন্ড এটমোসফেরিক এডমিনিস্ট্রেশন মারমেইডের বিষয়টি গোপন করছে বলেও তারা দাবি করে। ডকুমেন্টারিতে ২০০৯ সালে ইসরায়েলের এক উপকূলে মারমেইডের মতো কোন এক প্রাণীর এক ভিডিও ক্লিপ দেখানো হয়।
লিভারপুল সমুদ্র সৈকতে মারমেইডের কঙ্কাল
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের লিভারপুলের একটি সমুদ্র সৈকতে মৎস্যকন্যার শারীরিক গঠনের ন্যায় একটি কঙ্কাল উদ্ধার হয়েছে। যেটি অনুরূপ মৎস্যকন্যার কঙ্কাল বলে মনে করা হচ্ছে! এই বিরল ছবি সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার হতেই ঝড়ের গতিতে ভাইরাল হয়ে যায়। হয়তো কল্পনার সেই মৎস্যকন্যার সাথে মিল পেয়ে নেটিজেনরা মুগ্ধ হয়েছে এই কঙ্কাল দেখে।
১ জুন ২০২১ এক ব্রিটিশ দম্পতি বেড়াতে গিয়েছিলেন লিভারপুলের সমুদ্রসৈকতে। সেখানেই ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ একটি অদ্ভুত জিনিস দেখে এগিয়ে যান স্ত্রী। আর তিনিই আবিষ্কার করেন এই কঙ্কালটি। তারপর সেটির ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে আপলোড করেন। দেখতে দেখতে ভাইরাল হয়ে ওঠে সেই ছবি। তবে এই ছবি কতদূর সত্যি, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সূত্র মতে, যুক্তরাষ্ট্রের লিভারপুল শহরের মের্সিসাইড সৈকতে পার্টিতে গিয়ে এই পরিবারটি এই মৎস্যকন্যার কঙ্কালটি খুঁজে পেয়েছিল। ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১ জুন ২০২১ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ক্রিস্টি জোন্স নামে এক ব্যক্তি, তার গোটা পরিবারকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন। তারা প্রত্যেকেই সামদ্রিক আবহাওয়া উপভোগ করছিলেন। তবে সেই পরিবারের কোনও এক সদস্য মৎস্যকন্যার কঙ্কালটি প্রথম দেখতে পান। শুরুতে তারা একটু ভয় পেলেও, সেই ভয় কাটিয়ে তারা আন্দাজ করে এটি অনুরূপ মৎস্যকন্যা।
স্থানীয় এক সংবাদমাধ্যমের দেয়া সাক্ষাৎকারে ক্রিস্টি জনিয়েছেন, “কঙ্কালটি সন্ধানের বিষয়টি জানতে পেরে কর্তৃপক্ষ এটিকে তাদের হেফাজতে নিয়েছে এবং তদন্ত শুরু করেছে। তবে এখনও তারা বুঝতে পারছে না এটি কী। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কর্মকর্তারা এটাকে একটি মৎস্যকন্যার কঙ্কাল হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন।”
মৎস্যকন্যা দেখার প্রচলিত যত ঘটনা
মৎস্যকন্যা দেখেছেন এমন মানুষের মধ্যে সবার আগে চলে আসে বিখ্যাত নাবিক কলম্বাসের নাম। ১৪৯৮ সালে আমেরিকা আবিষ্কার করে পৃথিবীর ইতিহাসে আলাদা করে জায়গা করে নেয়া কলম্বাসের লগবুকেও রয়েছে মৎস্যকন্যার উল্লেখ। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের লগ বুক অনুসারে তিনি যখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন নাকি এক অর্ধমানবী অর্ধমাছকে সমুদ্রবেলায় বসে থাকতে দেখেছেন। এটিকে অনেকে উড়িয়ে দিলেও বিশ্বাসীরা একেই মানছেন মৎস্যকন্যাদের অস্তিত্বের সপক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে।
১৮৩৩ সালের ঘটনা। আইল অব ইয়েল এ ছয় জন জেলে নাকি এক মেয়েকে তাদের জালে আটকায়। তিন ফুট লম্বা ওই মেয়ে নাকি জেলেদের নৌকায় ওঠার পর তিন ঘণ্টা ছিল, সে নাকি জেলেদের সঙ্গে কোনো সংঘাতে যায়নি। শুধু আস্তে আস্তে ফোঁপাচ্ছিল। ওই মেয়ের নাকি মাছের মতো লেজ ছিল না। কিন্তু তার দেহে সামান্য আঁশ ছিল। জেলেরা মারাত্মক ভয় পেয়ে যায়। সাগরের মধ্যে তারা আর প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে ইশারায় মেয়েটিকে চলে যেতে বলে। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি হেনে মেয়েটি নিখুঁত এক ড্রাইভ দিয়ে সাগরে চলে যায়। এ গল্প এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির ন্যাচারাল হিস্ট্রির প্রফেসর ম্যাক্লিহানকে শুনান এডমন্ডসন নামে এক জাহাজের কাপ্তান।
এরপর ১৮৪৭ সালের কথা। ৮০ বছর বয়স্ক একজন জেলে দাবি করেন তিনি নাকি উপকূল থেকে ২০ গজ দূরে এক মৎস্যকন্যা দেখেছিলেন। তার বর্ণনা অনুসারে মৎস্যকন্যা তখন গলদা চিংড়ির দাঁড়া দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। তবে খুব বেশিক্ষণ তাকানো যায়নি মৎস্যকন্যার দিকে। যখনই ওই মৎস্যকন্যা বুঝতে পারল কেউ তাকে দেখছে, ওমনি টুপ করে পানির মধ্যে তলিয়ে যায়।
তারপর ১৮৫৭ সালের জুন মাসের ৪ তারিখ ব্রিটিশ শিপিং গ্যাজেটে উল্লেখ আছে এক স্কটিশ নাবিক নাকি সাগরের মধ্যে ঢেউয়ের ওপর এক কিশোরীকে বসে থাকতে দেখেছে।
সাম্প্রতিককালে মৎস্যকন্যা দেখা যাওয়ার একটি ঘটনা ঘটেছে ইসরাইলের কিরইয়াট ইয়াম অঞ্চলে। দুজন বন্ধু পাহাড়ের উপর থেকে সমুদ্র তীরে একটা পাথরের উপর মাছের মতো একটা প্রাণী বসে থাকতে দেখে। তারা অই প্রাণীর ভিডিও করতে শুরু করে। প্রাণীটি মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে। এবং পালিয়ে যায়। এই ভিডিওটি তারা ফেসবুকে আপলোড করার পর রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়।
তবে মৎস্যকন্যা দেখা যাওয়ার যে ঘটনাটা সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, তা ঘটেছিলো ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের দীঘা সমুদ্র উপকূলে। বিস্তারিত তথ্য পাওয়া না গেলেও ছবিতে এবং স্বল্প সময়ের একটি ভিডিওতে দেখা গেছে অদ্ভুত এক প্রাণীর আরও অদ্ভুত শারীরিক গঠন। এই প্রাণীটির মাথা ছিল সম্পূর্ণ মাছের মতো। তবে গলা থেকে দেহের বাকি অর্ধেক ছিল হুবুহু মানুষের মতো। তবে তার হাত দুটো পেছনে বাঁধা ছিল। ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রাণীটি তখনও জীবিত ছিল। তবে এটি ঠিক কোন ধরনের প্রাণী বা এটির নাম কি তা কেউ এখন পর্যন্ত জানতে পারেনি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রাণীটি বন্দর কর্তৃপক্ষের হেফাজতে ছিল।
এদিকে, ২০০৬ সালে সুনামির পর মালয়েশিয়া সাবা উপকূলে একটি মৃত মৎস্যকন্যা ধরা পড়ে। পরে জানা যায় জুয়ান ক্যাবান নামে এক ফটোগ্রাফার ক্যামেরার কারসাজিতে এটা করে। ২০১৬ সালে ফ্রান্সের এক ব্যক্তি এবং ২০১৯ সালে এক আফ্রিকা পর্যটক একইরকম দুটি ছবি শেয়ার করেছিলেন সামাজিক মাধ্যমে। সেগুলিও একইরকম ভাইরাল হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু পরে দেখা যায় একটি ছবিও আসল নয়। মানুষের কঙ্কাল এবং মাছের কঙ্কালের ছবি জুড়ে তা তৈরি করা হয়েছে। মারমেড বা মৎস্যকন্যা আজও এক রহস্য। অনেকেই বিশ্বাস করেন এক সময় পৃথিবীতে সত্যিই এমন প্রাণীর বাস ছিল। আবার বিবর্তনের জানা তত্ত্বগুলি মেনে নিলে তা সম্ভব নয়। সত্যিই মারমেডের কঙ্কাল পাওয়া গেলে প্রশ্নের মুখে পড়বেন ডারউইনও।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২০৮
আপনার মতামত জানানঃ