যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায় চুতর্থবার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন বাশার আল আসাদ। ফলে আরও ৭ বছর ক্ষমতায় থাকবেন তিনি। যদিও সিরিয়ার বিরোধী দলগুলো এই নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ আখ্যা দিয়েছে। পাশাপাশি আমেরিকা-সহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলিও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যদিও তাতে আমল দিতে নারাজ আসাদ।
বৃহস্পতিবার রাতে দেশের দেশের পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচনের ফল ঘোষণা করেন।
দেশটির পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচনের যে ফল ঘোষণা করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনে ভোটদানের হার ৭৮.৬ শতাংশ। এর মধ্যে আসাদ পেয়েছেন ৯৫.১ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে, তার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল্লাহ সালৌম আবদুল্লাহ ও মাহমুদ আহমেদ মারেয়ি পেয়েছেন যথাক্রমে ১.৫ শতাংশ এবং ৩.৩ শতাংশ ভোট।
বুধবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে এক কোটি ৪২ লাখ ৩৯ হাজার। আসাদ ভোট পেয়েছেন এক কোটি ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ৩৬০টি। মারেয়ি চার লাখ ৭০ হাজার ২৭৬ ভোট এবং আব্দুল্লাহ দুই লাখ ১৩ হাজার ৯৬৮ ভোট পেয়েছেন।
এই বিপুল জয়ের ফলে আসাদ আরো সাত বছর সিরিয়া শাসনের অধিকার পেলেন। আসাদ সরকারের দাবি, এই নির্বাচনই দেখিয়ে দিল, এক দশক পুরনো সংঘাত সত্ত্বেও সিরিয়ার মানুষ স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছেন। এই সংঘাতে কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছেন। দেশের অর্ধেক মানুষ তাদের বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
বুধবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষিত হওয়ার পর এক বাণীতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বলেছেন, আগামীকাল থেকেই কাজে নেমে পড়তে হবে যাতে সিরিয়ার পুনর্গঠনের প্রতি মানুষে আশা বেড়ে যায়।
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সানা নিউজের খবরে বলা হয়েছে, চতুর্থবারের মতো সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে আসাদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ ও জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রদর্শন করার জন্য জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
প্রেসিডেন্ট আসাদ বলেন, নির্বাচনের পর্ব শেষ এবং কাজ করার পালা। তিনি বিগত এক দশকের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে আত্মদানকারী সিরীয় সৈন্যদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, তাদের আত্মত্যাগের কারণে আজ জনগণ একটি নিরাপদ সিরিয়ায় বসবাস করতে পারছে।
সিরিয়ায় প্রায় ৬ দশক ধরে ক্ষমতায় আসাদের পরিবার। তার বাবা হাফিজ আল আসাদ ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর উত্তরসূরী হিসেবে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন বাশার আল আসাদ। ২০০০ সালে তিনি এই কুর্সিতে বসেন।
কিন্তু তার দশ বছর পর থেকেই সিরিয়ায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। ২০১১ সালে আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন বিরোধীরা। তাতেই গুলি চালায় সরকারের বাহিনী। এরপরই দেশটিতে গৃহযুদ্ধের সূচনা হয়। একদিকে রাশিয়া-ইরানের সমর্থন পায় আসাদবাহিনী। অন্যদিকে, আমেরিকা এবং পশ্চিমা দেশগুলির সমর্থন পেতে থাকে বিদ্রোহী এবং কুর্দ জঙ্গিদের বাহিনী।
দু’পক্ষের মধ্যে এখন পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী এই লড়াইয়ে প্রায় হারিয়েছেন প্রায় চার লক্ষ মানুষ। ইতিমধ্যে রাশিয়া এবং ইরানের সাহায্যে দেশের ৭০ শতাংশ এলাকা নিজেদের দখলে নিয়েছে আসাদবাহিনী। কিন্তু বাকি ৩০ শতাংশ কিছুটা কুর্দ জঙ্গি এবং বিরোধীদের দখলে রয়েছে।
তবে যুদ্ধের কারণে দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। এর মধ্যে বিদেশে শরণার্থী শিবিরে রয়েছেন প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ। এই পরিস্থিতিতেই এবারের নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মূলত সরকারি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এবং বিদেশে সিরিয়া কিছু দূতাবাসে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে।
তবে নির্বাচনের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ হয়েছে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ইদলিব প্রদেশে।
এদিকে সিরিয়ার নির্বাসিত বিরোধী নেতারা এই নির্বাচনকে ‘প্রহসন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সিরিয়ান নেগোসিয়েশন কমিশনের মুখপাত্র ইয়াহইয়া আল আরিদি একে সিরীয় জনগণের অবমাননা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করতে রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতায় এটি সরকারি একটি সিদ্ধান্ত। এটা স্বৈরতন্ত্রকেই চালু রাখা।’
এছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এক বিবৃতিতে এই নির্বাচনকে ‘অবৈধ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। নির্বাচনের আগে দেওয়া ওই বিবৃতিতে তারা বলেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধান ছাড়া এটি অবাধও নয়, সুষ্ঠুও নয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা সিভিল সোসাইটি সংগঠন ও বিরোধী দলসহ সিরীয় জনগণের কণ্ঠকে সমর্থন করি, যারা এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে অবৈধ আখ্যায়িত করেছেন।’
আমেরিকা ও ইইউ এই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের মতে, জাতিসংঘের প্রস্তাব মানা হয়নি। নির্বাচনে আন্তর্জাতিক তদারকির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেখানেই মানুষ ভোট দিতে পেরেছেন। কিন্তু সিরিয়ায় লড়াইয়ের ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চলে গিয়েছেন, তারা ভোটে অংশ নেননি বা নিতে চাননি।
আমেরিকা ও ইউ-র কর্মকর্তাদের মতে, মাত্র তিনজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পেরেছেন। প্রায় ৪৮ জন প্রার্থী হওয়ার জন্য মনোনয়নপত্র পেশ করেছিলেন, কিন্তু তা খারিজ হয়ে যায়। আসাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন তারই সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ সালুম আবদুল্লাহ এবং সরকার স্বীকৃত বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা মাহমুদ আহমেদ। ফলে এই বিরোধিতা ছিল অনেকটাই প্রতীকী।
আসাদ অবশ্য এই সমালোচনা উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ”এই সব কথার কোনো গুরুত্ব নেই।”
এর আগে দেশজুড়ে লড়াইয়ের মধ্যে ২০১৪ সালেও সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা বিরোধীরা বর্জন করেছিল। এরপর থেকেই যুদ্ধ পরিস্থিতি আসাদের অনুকূলে যেতে থাকে এবং রাশিয়ার বিমান হামলা আর ইরানের সামরিক সহযোগিতায় বড় শহরগুলিতে আসাদবাহিনী আবারও কর্তৃত্ব স্থাপনে সক্ষম হয়। আর এবার ভোটেও জিতে গেলেন বাশার আল আসাদ। তবে সামনে তার চ্যালেঞ্জও কম নয়। বিশেষ করে এতদিনের যুদ্ধের পর দেশের অর্থনীতিকে পুনরায় চাঙ্গা করা এবং দেশের বাকি অংশ পুনরুদ্ধার করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ