ভারতজুড়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে করোনাভাইরাস। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে এমনিতেই জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যেই আতঙ্ক ছড়াচ্ছে নতুন আরও কিছু রোগ। করোনার মধ্যেই নতুন আতঙ্ক ছড়িয়েছে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস। ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের পর হোয়াইট ফাঙ্গাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চেয়েও সাংঘাতিক। তবে এখানেই শেষ নয়। এবার ভারতের গাজিয়াবাদে ইয়েলো ফাঙ্গাসের সন্ধান মিলেছে। আর এই ফাঙ্গাসটি নাকি ব্ল্যাক ও হোয়াইট ফাঙ্গাসের থেকেও সাংঘাতিক।
চিকিৎসকরা বলছেন, ইয়েলো ফাঙ্গাসের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই সতর্ক হতে হবে। না হলে শরীরের ভেতরে অনেক বেশি ক্ষতি হতে পারে।
ভারতে প্রথম শণাক্ত
ভারতে ব্ল্যাক ও হোয়াইটের পর এবার ইয়েলো ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার খবর বেরিয়েছে।
ভারতের উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদ এলাকায় ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শরীরে ইয়েলো ফাঙ্গাসের সংক্রমণের লক্ষণ দেখা গেছে বলে এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের বরাত দিয়ে গতকাল সোমবার খবর প্রকাশ করেছে সংবাদ সংস্থা এএনআই। একই রোগীর ব্ল্যাক ও হোয়াইট ফাঙ্গাসের লক্ষণ ছিল বলে খবরে জানানো হয়।
উত্তর প্রদেশে ইয়েলো ফাঙ্গাসের সংক্রমণের খবর জানিয়েছে ভারতের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণত বিভিন্ন পোকার শরীরে হলুদ ছত্রাক দেখা যায়।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়েলো ফাঙ্গাস সংক্রমণের বিষয়ে খুব বেশি তথ্য নিশ্চিত না করলেও এটি হোয়াইট ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চেয়ে আরও বেশি মারাত্মক বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা।
ভারতের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা এএনআইকে নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ড. বিপি তিয়াগী জানান, ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির দেহে একই সঙ্গে কালো, সাদা ও হলুদ ছত্রাকের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পোকার শরীরে সাধারণত ইয়েলো ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেখা যায়। মানুষের শরীরে এ ছত্রাক এর আগে আমি কোনোদিন দেখিনি।’
ইএনটি বিশেষজ্ঞ বিপি ত্যাগীর ভাষ্যমতে, ইয়েলো ফাঙ্গাসের সংক্রমণ প্রাণঘাতী। প্রাথমিকভাবে সংক্রমণ শনাক্ত করা গেলে তা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
ইয়েলো ফাঙ্গাসের উপসর্গ
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সাধারণত সংক্রমিত ব্যক্তির ওজন কমে যাওয়া, ক্লান্তিভাব, ক্ষুধা না পাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা যায়। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে রোগীর দেহে পুঁজ ফেটে যাওয়ার মতো উপসর্গও দেখা গেছে। এছাড়া ক্ষত থাকলে তা না সারা বা শুকাতেও সময় লাগে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। সেই সঙ্গে চোখ বসে যাওয়ার মতো লক্ষণও দেখা দেয়। শেষমেশ সংক্রমিতের দেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে পচন ধরে বলে জানা গেছে।
ইয়েলো ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেহের ভেতরে প্রভাব বিস্তার করে বলে চিকিৎসকরা একে ব্ল্যাক বা হোয়াইট ফাঙ্গাসের তুলনায় ক্ষতিকর বলে দাবি করছেন। এ ফাঙ্গাসের উপসর্গ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা শুরু করা উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
চিকিৎসকদের মতে, স্বাস্থ্যবিধিতে অবহেলা করলে এই ফাঙ্গাসের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে বাসি খাবার খাওয়া বা অত্যন্ত বেশি আর্দ্র পরিবেশে থাকলেও এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
বিপি ত্যাগীর ভাষ্যমতে, ইয়েলো ফাঙ্গাসের লক্ষণগুলো হলো ক্লান্তিবোধ, ক্ষুধা না থাকা, ওজন হ্রাস। সংক্রমণ মারাত্মক হলে সে ক্ষেত্রে ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ বের হওয়া, ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হওয়া, অপুষ্টি, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল, চোখ বুজে আসা প্রভৃতি।
সরকারের করোনা সংক্রান্ত ব্রিফিংয়ে এইমসের প্রধান রণদীপ বলেন, করোনা রোগীদের মধ্যে ফাঙ্গাসের সংক্রমণের ক্ষেত্রে নানা ‘শব্দ’ ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
চিকিৎসা ও করণীয়
এই ধরনের কোনো উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ দরকার। নিজেকে সব সময় সুরক্ষিত রাখা দরকার।
চিকিৎসকরা বলছেন, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণহীন হলে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে গেলে ইয়েলো ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এ ছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেও ছত্রাকের সংক্রমণ বাড়ে। অতিরিক্ত গরমে আর্দ্রতা বাড়লে এই রোগ ছড়ায়। চিকিৎসকরা বলছেন, গরমে আর্দ্রতা বাড়লে ছত্রাক দ্রুত ছড়ায়। প্রথমেই ধরা পড়লে অ্যান্টি-ফাঙ্গাস ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
মিউকরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের মতো ইয়েলো ফাঙ্গাসের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অ্যাম্ফোটারেসিন-বি ইঞ্জেকশন দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের চিকিৎসক ডা. তিয়াগি।
এই ভয়াবহ রোগ থেকে বাঁচতে চিকিৎসকরা যেসব পরামর্শ দিচ্ছেন সেগুলো হচ্ছে-
১. নিজের রুম, বাসা-বাড়ি এবং বাড়ির আশেপাশের জায়গা যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখতে হবে।
২. বাসি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৩. ঘরের আদ্রতা যেন বজায় থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর ঘর যেমন পরিষ্কার রাখা জরুরি একইভাবে ইয়েলো ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগীর ঘরেও পর্যাপ্ত বাতাস এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জরুরি।
৪. করোনায় আক্রান্ত রোগীদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা শুরু করা উচিত যেন ইয়েলো ফাঙ্গাসের মতো জটিলতা সৃষ্টি হতে না পারে। সাধারণত করোনায় আক্রান্ত বা এ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা রোগীদের বিভিন্ন ধরনের ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তাই এ ধরনের লোকজনের স্বাস্থ্যের বিষয়ে শুরু থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।
ভারতে ফাঙ্গাসের সর্বশেষ পরিস্থিতি
এ পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ৯ হাজারের বেশি মানুষের দেহে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্ত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
বিহার আর মধ্য প্রদেশে শনাক্ত হয় হোয়াইট ফাঙ্গাস। এটিও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের মতোই প্রাণঘাতী। মস্তিষ্ক, শ্বাসতন্ত্র আর পরিপাকতন্ত্রে ছড়ায় এটি।
চলমান পরিস্থিতিতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় ছত্রাক সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত একমাত্র ওষুধ অ্যাম্ফোটারিসিন বির ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে ভারতে। সংকট মেটাতে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অর্থাৎ করোনাভাইরাস মহামারির আগে বিশ্বে প্রতি ১০ লাখ মানুষের ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ দশমিক ৭।
বিরল এসব ছত্রাকের সংক্রমণ সাধারণত ‘মিউকর মোল্ড’ জাতীয় এক ধরনের শ্লেষ্মার সংস্পর্শে এলে হয়।
এই শ্লেষ্মার দেখা মেলে মূলত মাটি, গাছ, সার, পচে যাওয়া ফল-সবজিতে, যা সবকিছুতেই ছড়াতে পারে। মাটি ও বাতাসের মাধ্যমে নাক হয়ে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষকেও আক্রান্ত করতে পারে এটি।
শীত ও বসন্তের তুলনায় গ্রীষ্ম ও শরৎকালে এ ছত্রাকের সংক্রমণ বেশি হয়ে থাকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৬
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ