প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে মহাবিপর্যয় নেমে এসেছে ভারতে। এই ভাইরাসের প্রকোপে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশটি। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে যে ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে সাম্প্রতিক ঝুঁকিপূর্ণ মূল্যায়ণে দেখা গেছে এই দেশে কোভিড ১৯এর সংক্রমণ পুনরুত্থান ও ত্বরণ এর বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। যার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গণসংযোগ অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানগুলিকে কেন্দ্র করে যে ভিড় তৈরি হয়েছিল সেখান থেকেই সংক্রমণ দ্রুততার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে।
করোনা বিষয়ক সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে বৈশ্বিক সংস্থাটি। খবর: আনন্দবাজার।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতির কারণ খতিয়ে দেখতে গিয়ে তারা জানতে পেরেছেন, দেশটিতে সংক্রমণ বৃদ্ধির অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হল বড় বড় রাজনৈতিক জনসভা এবং ধর্মীয় জমায়েত।
ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ভারতে সার্স-কোভ-২ বা করোনাভাইরাসের যে ধরনটি শনাক্ত হয়েছে, সেই বি.১.৬১৭ দেশটিতে সাম্প্রতিক উচ্চ সংক্রমণ পরিস্থিতির জন্য দায়ী।’
তবে ভারতে বর্তমানে করোনায় যে মাত্রায় দৈনিক আক্রান্ত ও মৃত্যু হচ্ছে, তাতে এই পরিস্থিতির বি.১.৬১৭ ধরনটির উচ্চ সংক্রমণ ক্ষমতার পাশপাশি অন্যান্য কিছু বিষয়ও অনুঘটকের কাজ করেছে। এক্ষেত্রে যেটি সবার আগে এসেছে— ভারতের কয়েকটি রাজ্যে সম্প্রতি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে বড় বড় কিছু সমাবেশ ঘটার ব্যাপারটি।’
‘ওই সমাবেশগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার কোনো প্রবণতা কারোর মধ্যেই দেখা যায়নি। যেখানে এমনিতেই প্রচলিত করোনাভাইরাস সার্স-কোভ-২ এর তুলনায় এর অভিযোজিত (মিউট্যান্ট) ধরন বি.১.৬১৭ এর সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি, সেখানে এই সমাবেশগুলো ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বলে মনে করে ডব্লিউএইচও।’
আসলে প্রথম দফার সংক্রমণের গতি কিছুটা কমতেই ভারত সরকার তথা সাধারণ মানুষ করোনা নিয়ে অনেকটাই গা-ছাড়া মনোভাব দেখিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বিধি তো মানেইনি, উল্টো বড়বড় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাবেশ হয়েছে দেশটিতে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই দূরত্ববিধি অমান্য করে ৭টি রাজ্যে নির্বাচন হয়েছে।
দেশটির খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একের পর এক বড় বড় জনসভা করেছেন। একই দোষে দুষ্ট বিরোধী শিবিরও। শুধু রাজনৈতিক সমাবেশ নয়, এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে কুম্ভমেলার মতো ‘সুপার স্প্রেডার’ ধর্মীয় সমাবেশ হয়েছে। বহু পুজো-অর্চনা এবং অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে জমায়েতের অনুমতি দিয়েছে সরকার। এগুলোকেই দেশে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহ আকার নেওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ল্যানসেট এবং নেচার পত্রিকার পর এবার ভারতে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য সরাসরি রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সমাবেশকে দায়ী করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও।
এর আগে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকা ল্যানসেট ভারতে ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সমাবেশের মতো অতি সংক্রামক (সুপার স্প্রেডার) অনুষ্ঠানকে দায়ী করেছিল।
সেই প্রতিবেদনে সরাসরি নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ডানপন্থী সরকারের সমালোচনাও করেছিল ল্যানসেট।
মোদি সরকারের সরাসারি সমালোচনা করে পত্রিকাটি লিখেছে, বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও সরকার ধর্মীয় উৎসব পালন এবং রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের মতো অতি সংক্রামক অনুষ্ঠান হতে দিয়েছে। এই ধরনের অতি সংক্রামক বা সুপার স্প্রেডার অনুষ্ঠানই বিপদ ডেকে এনেছে ভারতে।
সমালোচকদের চুপ করিয়ে দেওয়া এবং খোলা মনে পরামর্শ নিতে না চাওয়ার সরকারি মনোভাবই ভারতের সংকট বাড়িয়েছে, যা কোনোভাবেই ক্ষমা করা যায় না বলেও লিখেছে পত্রিকাটি।
৩০ এপ্রিল প্রথমবারের মতো ভারতে একদিনে ৪ লাখ মানুষ আক্রান্ত হন করোনায়। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনোদিন চার লাখ, কোনোদিন এর কিছু বেশি বা কম মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন দেশটিতে।
ডব্লিউএইচওর সাপ্তাহিক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সম্প্রতি যত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন তার ৯৫ শতাংশই ঘটছে ভারতে, আর এ রোগে দৈনিক মৃত্যুর দিক থেকে এই হার বর্তমানে ৯৩ শতাংশ।
এছাড়া বিশ্বে প্রতিদিন যত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন, তার অর্ধেক অর্থাৎ ৫০ শতাংশই হচ্ছেন ভারতে এবং পৃথিবীজুড়ে প্রতিদিন যত মানুষ এ রোগে মারা যাচ্ছেন, তার ৩০ শতাংশ ঘটছে ভারতে।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৃহস্পতিবার সকালের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ১২০ জনের। মোট মৃত্যু দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৩১৭ জনে।
ভারতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা গত চার দিন ধরেই সাড়ে তিন লাখের আশপাশেই রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭২৭ জন। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত হয়েছেন ২ কোটি ৩৭ লাখ ৩ হাজার ৬৬৫ জন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯০১
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ