আরাফাত মুন্না : ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি। হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা হয়। এ হামলায় সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ পাঁচজন নিহত হন। ১০ বছর পর ২০১৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ হত্যাকান্ডের বিচার শুরু করে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। আইন অনুযায়ী ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও বিচার শুরুর চার বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি। শুধু এ মামলা নয়, সারা দেশে নয়টি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৩ হাজার। এর মধ্যে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে ২৮৮টি মামলা। আইনজ্ঞরা বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা দেশের বিচার বিভাগের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করা হলেও সাক্ষী না আসা, প্রয়োজনের তুলনায় কম ট্রাইব্যুনাল থাকাসহ নানা কারণে এখানেও মামলা নিষ্পত্তির গতি কম। ফলে সাধারণ মানুষ আইনের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
তারা বলেন, বিচারপ্রার্থীদের জন্য দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে সমাধান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাড়াতে হবে নজরদারি। ঢাকায় চারটি এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে একটি করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে নয়টি ট্রাইব্যুনালে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৯৩৫টি। এর মধ্যে পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে ২৮৮টি মামলা এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে আরও ৯৬টি। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালগুলোতে মোট বিচারাধীন মামলার মধ্যে শুধু ঢাকার চার ট্রাইব্যুনালেই ১ হাজার ৭২৬টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে ২৫৮টি মামলা এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে আরও ৬৪টি।
আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে প্রণয়ন করা হয় ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘœকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন’। আর এ আইনের অধীনে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একই বছর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইনও প্রণয়ন করে তৎকালীন সরকার। দ্রুত বিচার আইন প্রণয়নের সময় দুই বছরের জন্য আইনটি করা হলেও বিভিন্ন সময়ে এর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এ আইনের মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়িয়েছে সরকার। সংশোধিত আইনে মামলা নিষ্পত্তিতে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে ১২০ দিন। এই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না গেলে কারণ উল্লেখ করে বিচারক আরও ৬০ দিন সময় বৃদ্ধি করতে পারবেন বলেও সংশোধিত আইনে উল্লেখ রয়েছে। দ্রুত বিচারের মামলায় দীর্ঘসূত্রতার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিচার বিলম্ব আমাদের বিচার বিভাগের অন্যতম একটি সমস্যা।
মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে যেমনভাবে বিচারপ্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি সরকারও কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই যেসব কারণে মামলার দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে তা নির্ণয় করে সমাধান করা উচিত। তাহলে বিচারপ্রার্থীরা সুবিচার পাবেন।’ তিনি বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার জন্য মূলত সাক্ষী না আসা এবং বিচারকাজ মুলতবি হওয়া প্রধানত দায়ী। রাষ্ট্রপক্ষের কাজ হবে যে কোনোভাবে সাক্ষী হাজির করা এবং মুলতবি ঠেকানো। তাহলেই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন মনে করেন, এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে সরকারের মনিটরিং খুব জরুরি। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের বিচারক-স্বল্পতা রয়েছে এটা অস্বীকার করা যাবে না। একই সঙ্গে বিচার চলাকালে বারবার সমন দিয়েও সাক্ষীদের হাজির করা যায় না। সে ক্ষেত্রে বিচারক চাইলেও মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারেন না। এ জন্য এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত বিচারের মামলাগুলোর ওপর সরকারের মনিটরিং আরও বাড়াতে হবে।’ সব মিলিয়ে আইনের সুফল পেতে হলে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে বলেও মত তার।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন
আপনার মতামত জানানঃ