পাল্টে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি। শক্তি বাড়ছে ইরানের। একা হয়ে পড়ছে ইসরাইল। সম্প্রতি ইরানের সাথে সৌদির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের প্রভাব কমেছে বেশ কিছুটা। সৌদি আরব ও ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি খোলামেলা না হলেও সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্বের কাছে আরও ভালোভাবে উন্মোচিত হয়েছে এই সম্পর্ক। মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী রাজনীতির স্বার্থে গড়ে উঠেছিল সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ক। সেখানে সৌদির ইরানের দিকে ঝুঁকে পড়া আর আমেরিকার পরমাণু সমঝোতার ইঙ্গিতের পর বিভিন্ন রাষ্ট্রের ক্রমাগত চাপ বৃদ্ধিতে মধ্যপ্রাচ্যে একা হয়ে পড়ছে ইসরাইল।
এর আগেও ইসরাইল হুমকি দিয়ে বলেছিল, আমেরিকা যদি পরমাণু সমঝোতায় ফিরে আসে তাহলে তেলআবিব ইরানে হামলা চালাবে। তবে পর্যবেক্ষরা বিশ্বাস করেন, এ ধরনের হুমকির বেশিরভাগই ফাঁকা বুলি ছাড়া কিছু না এবং মার্কিন সমর্থন ছাড়া ইসরাইল কখনও ইরানে হামলা চালাতে সাহস করবে না, তাদের এই ধরনের শক্তিও নেই।
যুদ্ধের হুমকি ইসরাইলের
পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে চাইলে ইরানের সঙ্গে প্রয়োজনে যুদ্ধে জড়ানোর হুমকি দিল ইসরাইল। ইসরাইলের গোয়েন্দা মন্ত্রী এলি কোহেন সম্প্রতি এ হুমকি দিয়েছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন যখন পরমাণু সমঝোতায় ফেরার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে এবং এজন্য অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় আলোচনা চলছে, তখন ইসরাইলের মন্ত্রী এই হুমকি দিলেন।
এলি কোহেন বলেন, ইসরাইল কখনও ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির সুযোগ দেবে না। এ ব্যাপারে ইরানকে ছাড় দেয়া হবে না। আমাদের যুদ্ধবিমান মধ্যপ্রাচ্যের সব জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম এবং অবশ্যই তা ইরানেও পৌঁছাতে পারে।
এলি কোহেন আরও বলেন, আমেরিকা যদি ইরানের সঙ্গে পরমাণু সমঝোতায় ফিরে আসে তাহলে তেলআবিব কূটনীতিক প্রক্রিয়ার ধার ধারবে না বরং মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের মধ্যে পড়বে।
তিনি বলেন, তাদের যুদ্ধবিমান ইরানে পৌঁছাতে পারে। যেকেউ স্বল্প মেয়াদি লাভের কথা চিন্তা করবে তাদেরকে দীর্ঘ মেয়াদের কথাও মনে রাখতে হবে।
ইরানের শক্ত অবস্থান
সম্প্রতি ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের জাতীয় সংসদের স্পিকারের সিনিয়র সহকারি হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান বলেছেন, ইহুদিবাদী ইসরাইলের কোনো দুষ্কর্ম বিনা জবাবে পার পাবে না।
তিনি বলেন, আল-কুদস শহরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী একথা প্রমাণ করে দেয় যে, ইহুদিবাদী আগ্রাসনের মুখে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো তাদের শক্তি সামর্থ্য নিয়ে লড়াই করবে।
গত বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদ আন্দোলনের প্রতিনিধি নাসের আবু শরিফের সঙ্গে এক বৈঠকে হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর প্রতি পূর্ণ সমর্থন দেয়া হবে মুসলিম বিশ্বের জন্য সঠিক কার্যকর পদক্ষেপ।
ভিয়েনায় আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে
পরমাণু ইস্যুতে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানায় ইরান। ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের পরমাণু আলোচক এবং অন্যতম উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাকচি এ কথা বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই পরমাণু সমঝোতায় ফিরতে চায়, তা হলে তেহরানের ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা একসঙ্গেই তুলে নিতে হবে।
আরাকচি বলেন, ভিয়েনা বৈঠক শেষে পরমাণু সমঝোতায় টিকে থাকা সদস্য দেশগুলো আমেরিকার সঙ্গে কথা বলবে। এটি সম্পূর্ণ তাদের বিষয়। আমরা তাতে জড়িত থাকব না। আমরা শুধু পাঁচ জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলব।
ভিয়েনার ইম্পেরিয়াল হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে সম্পাদিত পরমাণু চুক্তির ছয় দেশের মধ্যে বাকি পাঁচ দেশ-চীন, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
পরমাণু সমঝোতা পুরোপুরি পুনরুজ্জীবিত হবে: পুতিন
এদিকে গতকাল (শুক্রবার) রুশ ফেডারেশনের স্থায়ী নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইরানের পরমাণু সমঝোতা পুরোপুরি পুনরুজ্জীবিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
বৈঠকে পুতিন আরো বলেন, ইরান কাস্পিয়ান সাগর তীরবর্তী রাশিয়ার পাঁচ প্রতিবেশী দেশের অন্যতম। দেশটির পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে বর্তমানে আলোচনা চলছে।
আমি আশা করছি, পরমাণু সমঝোতা সংক্রান্ত সবগুলো বিষয় আগের অবস্থায় ফিরে যাবে।
চীন, রাশিয়া ও ইরানের আহ্বান
ইরানের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে অবিলম্বে পরমাণু সমঝোতায় ফিরে আসার জন্য আমেরিকার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে চীন, রাশিয়া ও ইরান।
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী এই তিন দেশের প্রতিনিধিরা গত মঙ্গলবার এক বৈঠক থেকে এ আহ্বান জানান।
সৌদি ও ইরানের মধ্যকার সম্পর্কের উন্নয়ন
সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল আল-আরাবিয়াকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ইরান হচ্ছে সৌদির প্রতিবেশী দেশ এবং তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা উচিত।
তিনি বলেন, দিন শেষে ইরান হচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আমরা সবাই ইরানের সঙ্গে ভালো ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক চাই।
এদিকে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খাতিবযাদে বলেছেন, সম্প্রতি তেহরান সম্পর্কে সৌদি আরব যে সুর করেছে তাকে স্বাগত জানায় তেহরান।
তিনি বলেন, ইরান ও সৌদি আরব দু’টিই আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি এবং তারা তাদের সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ করতে পারে।
খাতিবযাদে আরও বলেন, গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংলাপভিত্তিক মনোভাবের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক এবং মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশ দু’টি তাদের মতভেদ দূর করতে পারে এবং সম্পর্ক ও সহযোগিতার নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে পারে।
এই সম্পর্ক ও সহযোগিতার মধ্যদিয়ে আঞ্চলিক শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন আনা সম্ভব।
আমেরিকার গোয়ার্তমি
‘সর্বোচ্চ চাপ’ প্রয়োগের নীতি অনুসরণ করে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালের মে মাসে পরমাণু সমঝোতা থেকে আমেরিকাকে বের করে নেন।
এরপর এক বছর পর্যন্ত ইরান এই সমঝোতা বাস্তবায়নে সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল কিন্তু অন্য পক্ষগুলো সমঝোতা বাস্তবায়ন না করায় ৩৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে ইরান সমঝোতার বেশকিছু ধারা বাস্তবায়ন স্থগিত করে দেয়।
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার দেশকে এই সমঝোতায় ফিরিয়ে আনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তিনি ইরানকে আগে তার প্রতিশ্রুতিতে পুরোপুরি ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
কিন্তু ইরান বলেছে, আমেরিকা আগে এই সমঝোতা থেকে বেরিয়ে গেছে বলে তাকে আগে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে এতে ফিরে আসতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৬০৮
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ