মাসকাওয়াথ আহসান
মানুষ যখন ভরপুর উন্নয়নে পরিতৃপ্ত; দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেমের বাতাসে যখন তার পেট ফুলে রীতিমতো উন্নয়নের ঢোল; বাতাবি মিডিয়া যখন ভিক্ষুক মুক্ত জনপদের সুখে তাথৈ তাথৈ; ২০৩৫ সালে বিশ্বের ২৫ তম অর্থনীতি, ২০৪১ সালে স্বদেশ যখন ইউরোপ হয়ে উঠতে যাচ্ছে; আজি হতে শতবর্ষ পরে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’ পরিকল্পনার পরী যখন রঙ্গভবনের বাগানে ডানা মেলেছে; তখন প্রজাদের আনন্দের আর সীমা নাই।
অমাত্য যখন এও বলেন, উনি থাকতে করোনাকেও ভয় নেই; তখন আর ভয় কীসে!
হেলমেট পরে হাতুড়ি হাতে যখন উন্নয়নের জন হেনরি মাত্র দশবছরে কুঁড়ে ঘর থেকে দোতলা বাড়িতে উঠেছে; গোলি থেকে রাজপথে এই চেতনার দ্রাবিড় সংহতি; ঈমানের দ্রাবিড় দাড়ি সংহতি; তখন জনপদটাকেই বেহেশত বলে ভ্রম হয়। দুঃখ নেই; বেদনা নেই; শংকা নেই; শুধুই আশা আর আশার বেলুন উড়তে থাকে দেশপ্রেম ও ধর্মপ্রেমের গোয়ালে গোয়ালে; সেখানে নতুন যীশুরা জন্ম নিয়েছে মা মেরীর কোলে। পবিত্র দেশধর্মগ্রন্থ শেখোলজি হাতে এই যীশুরা ঘুরছে ফেসবুকে; বাতাবি লেবুর সুগন্ধী লেবু বাগানের ঘ্রাণ হয়ে।
চেতনা ও ঈমানের দ্রাবিড় সংহতি করোনাকালে সবাই দাড়ি রেখে এখন বাঙ্গির ব্যবসা করে। মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় বাঙ্গিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ফল। উন্নয়ন বেহেশতের গন্ধম। অসাম্প্রদায়িকতার লিপসার্ভিসের বিনিময়ে বাঙ্গি ও খিলাফতের লিপ সার্ভিসের বিনিময়ে বাঙ্গি খেতে খেতে নেতারা সব যেন এক এক জন ‘মেরা সুলতান’ হয়ে ওঠে। প্রমোদে ঢালিয়া দেয় মন, ওয়েস্টিনের পিউপাপিয়ায়; সোনারগাঁ জান্নাত রিসর্টে। বাংলালিক্স বুয়া টেলিফোনে আড়ি পেতে ‘ফোন কল ফাঁস’-এ যেন ঘনশ্যাম জুলিয়ান এসাঞ্জ হয়ে ওঠে। কিন্তু তাদের নানী-দাদীরা বেডরুম বিশারদ হওয়ায়; জীনগত পুলকে; বেড রুমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে বাংলালিক্স গোয়েন্দা বুয়া হয়ে ওঠে বাতাবি লেবু মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদক। দৈনিক বাতাবিকাল আবার রীতিমত বাংলালিক্স গোয়েন্দাকে দিয়ে এক বামনের মোবাইল ফোন থেকে জনবিনাশী পর্ণ মারণাস্ত্র উদ্ধার করে। টান টান উত্তেজনায় বাঙ্গিরা ফেসবুকে লিবিডো আনন্দে সাপের মতো হিস হিস শব্দ করে।
বেহেশতি জেওর খুলে সংস্কৃতি মোল্লারা প্রশ্ন তোলে ধর্ম মোল্লার প্রতি, কয়ডা হাঙ্গা করছো; কয়ডা সহি; খাঁটি নিকাহনামা কই। ধর্ম মোল্লা কটাক্ষ করে, গলায় গামছা দিয়া হারমোনিয়াম বাইন্ধা রবীন্দ্রনাথের হারাম গান গাইলেই ওইডা হাজার বছরের বাঙ্গি সংস্কৃতির লীলা; আর আমরা টাকনুর ওপর সালোয়ার পরি; মাথায় টুপি দিয়া কপালে নামাজের ঘাঁটি নিয়া সংস্কৃতি করলেই আমগো ক্যারেকটার ঢিলা! আওমি করলে লীলা আর কওমি করলে ক্যারেক্টার ঢিলা; এ কেমন বিচার!
সংস্কৃতি বাঙ্গি ধমক দিয়ে বলে, চুপ কর লালসালু।
ধর্ম বাঙ্গি পালটা ধমক দেয়, চুপ কর বাল সালু।
করোনার সময় কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে; এমন খবর এলে; রাজকোষের হিরক মন্ত্রী বলেন, এসব এনজিওর দেয়া দরিদ্রের সংখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়; বাংলালিক্স ও বাতাবি মিডিয়া দিয়া চেক করাইতে মন চায়। বালসালুরা ফেসবুকে সমস্বরে গান গায়, দারিদ্র্য নাই ওরে দারিদ্র্য নাই; লালসালুর খপ্পর থিকা মসনদ বাঁচানো চাই।
করোনায় লকডাউন দিলে, ইতালী প্রবাসী এক বাঙ্গি একে ফাক ডাউন বলে অভিহিত করে; এই লোকই এর আগে ফাক ইউ কান্ট্রি সিস্টেম বলে বালসালুদের চোখের বালি হয়েছিলো।
এক কিশোর মার্টিন লুথার কিং রাজপথে নির্বাক নূরহোসেনের মতো দাঁড়িয়ে সবাক হয়, সামনে ঈদ, দরিদ্র মানুষের কী যে হইবো; আবার দিলেন লকডাউন; আপনেগো মাথার খুলি দেকতেছি খুইলা বাসায় থুয়ে আসছেন; দাঁড়ায়ে আছেন এ ওর গায়ে ঠেস দিয়ে। থ্যাংক ইউ।
এক বালসালু এসে কিশোর মার্টিনের চোখ বরাবর ঘুষি দিয়ে বলে, তোরে তো বাঙ্গি বইলা মনে হয় না; পাকি নাকি!
বালসালু সাইবার যোদ্ধা পারবেন আপা ও তার সারিন্দারা গান গায়, পাকি-পাকি-পাকি।
কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে, এই কিশোরের ভিন্নমতটুকুও নেয়া গেলো না? তাকেও মারতে হবে; কী জঘন্য বালসালুরা।
জাস্টিফিকেশান ইউনিটের বালসালু এসে বলে, বস্তির শিশোরেরাই এই কিশোরের লগে মারামারি করছে। আন্নেরা ‘যন্ত্র ঐ একটাই ষড়যন্ত্র করবেন না!
তিনটি কাঁটাচামচ ও একটি খোপার কাঁটা সোনারগাঁ জান্নাত থেকে চুরির অভিযোগে লালসালুকে গ্রেফতার করা হলে; বুড়ো লালসালুরা বালসালুর মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেসে যায় তাকে ছাড়ানোর তদবির নিয়ে।
অথচ লালসালুর উস্কানিতে শাল্লায় আল্লার ভীতি তৈরি করে, শ্রীখণ্ডের মানবতার দাদুর সফরের বিরুদ্ধে অহিংস বিক্ষোভকে সহিংসতায় উস্কে দেয়ার অপরাধগুলোকে সামান্য ‘এটেম্পট টু মার্ডারে’র মৃদু অভিযোগে তাকে কারাগারে সহি সালামতে নামাজ আদায়ের সুযোগ করে দেয়ার নির্দেশ দেয় বাতাবি আদালত।
তদবিরের বিনিময়ে টেকাটুকা আর রঙ্গভবনের পিঠাপুলির যাত্রার থ্রি নট থ্রি ডান্সের পারবেন আপারা, দুপুরে বাঙ্গি খাওয়ার পর সুপারি চিবাইতে চিবাইতে রগড় করে, হাজব্যান্ড অফ হিউম্যানিটির লালসালু নিয়ে। হঠাত কলিংবেল বাজায় গোঁফেল সংস্কৃতিমামা; পারবেন আপা তখন রাবীন্দ্রিক বালুলতা হয়ে গান করে, বাকি আমি রাখবো না; রাখবোনা কিছুই বাকি আমি রাখবোনা।
হিজাবে মুখ ঢেকে লালসালুর হোমমিনিস্ট্রি যে ‘বাসায় আসেন’ বলে ঠান্ডা ধমক দেয়, সে টিফিন বাটিতে করে মুরগা-মুসাল্লাম নিয়ে জেলখানায় এসে দেখে অপেক্ষার বেঞ্চে বসে ‘লাভ জিহাদের লাল চড়ুই’। রেগে কাঁই হয়ে টিফিন বাটি ঝপ করে ফিরে যায় তার জলপাই নিবাসে। ত্রিভুজ জটিলতায় বিপন্ন একালের মজিদ। পৃথিবীতে হেভেন সেভেনটি টু করতে গিয়ে তার দফার রফা ফিশরোল হয়ে গেলো।
শ্রীখণ্ডের মানবতার দাদুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ১৭ জন লালসালুর ফুটসোলজার মৃত্যুর ব্লাড-মানি হিসেবে ১৭০০ উট চেয়েছে উটবাড়িয়ার লাল-বাবু-সালুরা। ওদিকে উন্নয়নের পুলিশ হাজার হাজার অজ্ঞাতনামার বিরুদ্ধে মামলা করে; পুরুষ শূন্য করেছে গ্রামের পর গ্রাম। সেই একাত্তরের যুদ্ধের বছরের মন বিশ একুশের ভয়ার্ত গ্রাম।
উন্নয়নের চৌকিদার এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা খনির ময়লা শ্রমিকদের পুলিশ গুলি করে মেরেছে।সাতজন শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য শ্রমিককে দায়ী করে চার্জশিট রচনায় বেনসন সিগ্রেট বাগিয়ে চিত্রনাট্য রচনায় বসেছে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’ বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত পুলিশ পিলু এলামনাস।
কিন্তু শেখোলজির তন্ময় সিংহ জীবনকে এতোটা সাদা কালোয় দেখেন না। তিনি দেখেন ধূসর এলাকা। দেশের মানুষ উন্নয়নের বেহেশতের স্বাদ পেয়েছে গত দশ বছরে। এদের অবস্থা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর কল্যাণ রাষ্ট্রের বেহেশতের মানুষের মতোই। অধিক সুখে এরা ব্যথামুক্ত আত্মহত্যার পথ খুঁজছে।
তাই তন্ময় সিংহ জলে নামিয়েছে হেভেনিক জাহাজ। এতে ধাক্কা লাগলেই বেহেশত গমন; কোন ব্যথা নেই; বেদনা নেই; লাভ বাইটের মতো সুখকর এক মৃত্যু।
তন্ময়ের হেভেনিক জাহাজে ধাক্কা লেগে লঞ্চের ৩৪ জন যাত্রীর মৃত্যুর খবরকে ঠেলতে ঠেলতে মিডিয়া মফস্বল পাতায় বামন বানিয়ে রেখেছে। বামন সার্কাসের যুগ। সুতরাং এই তন্ময়ের নিউজটিকে বামন করে রেখে; বামনওয়াজকারীর মোবাইলে ‘পর্ন’ পাওয়ার ব্রেকিং নিউজে ব্যস্ত করে তোলে বাংলা লিক্সের অবসর প্রাপ্ত বড় ভাই দৈনিক বাতাবিকাল।
এক সনাতন বাদ্য পুলিশ হেভেনিক জাহাজের বিরুদ্ধে মামলা না করে অজ্ঞাতনামা সোনারতরীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও; শেষ পর্যন্ত তন্ময় সিং -এর জাহাজের সারেং-বাবুর্চি ইত্যাদি জজমিয়াদের ‘কেষ্টা বেটাই চোর’ মামলায় ধরে ডিমান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের রূপকথার চার্জশিটে বলা হয়, উন্নয়নের সেতুর পিলারে ধাক্কা লেগে এই দুর্ঘট; তা ছাড়া উন্নয়নের হাজি সাহেবেরা শীতলক্ষার দুকূল দখল করে উন্নয়ন করছে; ফলে নদী হয়ে এসেছে চিকন; ওখানে জ্যাম লেগে থাকে সর্বক্ষণ। সুতরাং নিবন্ধন থাকলেও; জলকে চলার অনুমোদন নাই তন্ময় সিং এর হেভেনিক কার্গোর। তবু উন্নয়নের জরুরি মাল টেনিছিলো শেখের জাহাজ। শেখের গৌরবকে দ্রুত নাইনথ হেভেনে পৌঁছে দিতে সময় কোথা সময় নষ্ট করার।
বাতাবি জার্নালে মাতৃরূপেণ সংস্থিতারা; যারা লালসালুর মামুনুলের বেড রুমের গল্পে তোলপাড় তুলেছিলেন দর্শক লিবিডোতে; দর্শক ‘যৌবন জ্বালা পর্ন’ ওয়েবসাইট ফেলে বাতাবি জার্নাল আর সৈনিক বাতাবিকালের ওয়েবসাইটে ভিড় করতে শুধু করেছিল লালসার লালা মেখে; কিন্তু মাতৃরূপেণ সংস্থিতারা এবার অন্য জাদু দেখান, মৃত মানুষকে জীবিত করার জাদু। দর্শকের সামনে রূপস্থাপিকা জিজ্ঞেস করেন, আপনি কী করে মারা গিয়েছিলেন আউয়াল! স্ট্রিম ইয়ার্ডে যুক্ত মৃতদেহ তাকে উত্তর দেয়, নির্বাচন কমিশনের মাছ তাকে গিলে খেয়েছে। ভোটার করেনি। বাতাবি জার্নালের এই প্ল্যানচেট শো দেখে; নির্বাচন কমিশন মাছ আউয়ালকে উগলে দেয়; যেভাবে ইউনুস নবীকে উগলে দিয়েছিলো অলৌকিক মাছ; সে অনেক অনেক কাল আগের কথা।
জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় বাতাবি জার্নালের। উন্নয়নের আনন্দে ঠেলায় ঘুরতে থাকা মৃতেরা ফোন করে জানায়, বেঁচে উঠতে চায়। আরেকদল উন্নয়নে সুখি মানুষ তন্ময় সিং-এর হেভেনিক জাহাজের ধাক্কা খেতে লঞ্চের ট্যুর অপারেটরদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তন্ময়; হাইওয়ে টু হেভেন বিলবোর্ডে ছেয়ে যায় উন্নয়নের ভূমি বাস্তবতার বেহেশত। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কান্ট্রির লোকেরা উন্নয়নে বেহেশতে ডেথ ট্যুরিজমে আসতে ভিসার জন্য দৌড়াদৌড়ি করে।
ভীষণ ২০৩৫, ভীষণ ২০৪১, ভীষণ ২১২১-এর জাতিস্মর হবার লোভে; ‘যদি আরেকটিবার জন্মাই সখা প্রাণের মদিনায়’-এই গান গাইতে গাইতে জন-আত্মহত্যার চার্জশিটের রূপকথা লিখতে থাকে পুলিশ অকম্মার ঝুলি।
আপনার মতামত জানানঃ