বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে পরপর দুদিন গুলি করেছে পুলিশ। এমনকি দ্বিতীয় দিনে প্রথম দিনের মতো ফাঁকা গুলি না করে সরাসরি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়েছে পুলিশ। এমনটা করা কোনও গণতান্ত্রিক দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ারে নেই। তাই প্রশ্ন উঠছে ‘কেন আর কোন ক্ষমতার বলে’ পুলিশের এই স্বেচ্ছাচারিতা।
দিনদিন পুলিশ হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী। সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, আন্দোলনকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালানো এবং উপর্যুপরি মামলার ঘটনায় পুলিশ সিন্দাবাদের ভূতের মতো মানুষের কাঁধে চেপে বসেছে। বাঁশখালীতে সম্প্রতি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রে বকেয়া মজুরি ও রোজার দিনে কাজের সময় কমানোর দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পাঁচ শ্রমিকের মৃত্যু রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের সাক্ষ্য বহন করে। কারণ কোনও দাবি দাওয়া নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ বা বিক্ষোভ হতেই পারে, সেটা থামানোর উপায় কখনও নিরীহ শ্রমিকদের উপর গুলি চালানো হতে পারে না।
“পুলিশ আগেই গুলি করেছে৷ অনেকের মাথায় পিঠে গুলি লাগে৷ যে যেভাবে পেরেছি ছুটে পালিয়েছি৷”
বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিকেরা স্বাভাবিক কিছু দাবি তুলেছিলেন। যার মধ্যে ছিল বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং ইফতার ও সেহরির সময় ছুটি দেওয়া। যদি এ দাবি অযৌক্তিক না হয়, তাহলে পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির কাজ করতে গিয়ে কেন পাঁচ শ্রমিককে জীবন দিতে হবে। উল্লেখ্য, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে এটাই প্রথম প্রাণঘাতী ঘটনা নয়। ২০১৬ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকালে স্থানীয় লোকজন যখন এর বিরোধিতায় নেমেছিলেন, তখনও বিক্ষোভ দমনের সময় চারজন প্রাণ হারান।
বেতন-ভাতার দাবি করায় পুলিশের গুলি
গত শনিবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন৷ আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন কমপক্ষে ২৫ জন৷ বাঁশখালী কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। তারা কর্তৃপক্ষের কাছে মার্চ মাসের বকেয়া বেতন চেয়েছিলেন, যাতে রোজার দিনে গ্রামে পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠাতে পারেন। এ ছাড়া রোজার দিনে কাজের সময় কমিয়ে ৯ ঘণ্টা থেকে ৬ ঘণ্টা করা এবং ইফতার ও সেহরির সময় বিরতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। তারা বলেছেন, প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ করতে হবে।
শ্রমিকদের এসব দাবি নিয়ে মালিকপক্ষের যদি কোনো আপত্তি থাকে, তা নিয়ে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা যেত। মালিকপক্ষ যে সে পথ ধরেনি, সেটা স্পষ্ট। সাধারণভাবে আমাদের দেশের শ্রমিকদের যে বেতন, তাতে মাস চালানো কঠিন। তারপর মাসের মাঝামাঝি এসেও যদি আগের মাসের বেতন না পান, তাহলে তারা কীভাবে চলবেন!
সূত্র মতে, নির্মাণাধীন বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মধ্যেই পুলিশের একটি ক্যাম্প আছে৷ শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষ তাদের ন্যায্য আন্দোলন দমনে পুলিশকে ব্যবহার করেছেন৷ শ্রমিকরা দাবি করেছেন, পুলিশ আগেই গুলি করেছে৷ আমাদের রমজানে ইফতারের সময় দেয়া হয় না৷ আমরা বলেছি আমাদেরকে নামাজ, ইফতার ও রোজার ছুটি দিতে হবে৷ এসব দাবি না মেনে পুলিশকে দিয়ে আমাদের আন্দোলনে গুলি চালানো হয়েছে৷ আন্দোলন শুরুর পরই পুলিশ গোলাগুলি শুরু করে৷ অনেকের মাথায় পিঠে গুলি লাগে৷ যে যেভাবে পেরেছি ছুটে পালিয়েছি৷
ঘটনার পর বাঁশখালী এবং হাসপাতালে আহত শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, তাদের বেশ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত বেতন দেয়া হচ্ছিল না৷ সেই সঙ্গে তারা বেতন বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন৷ রোজার মাসে কাজের সময় পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছিলেন তারা, তাও মানা হচ্ছিল না৷ এছাড়াও শ্রমিকদের অভিযোগ সেখানে পানি ও টয়লেটের সংকট রয়েছে৷ আট ঘণ্টার পরিবর্তে ১০ ঘণ্টা কাজে বাধ্য করা হয়৷ তাদের সাথে সবসময় খারাপ ব্যবহার করা হয়৷ এনিয়ে তারা ১১ দফা লিখিত দাবি দিয়েছিল৷ শুক্রবারও তাদের কাজ করতে হয়৷ এনিয়ে শুক্রবার তারা বিক্ষোভ করেন৷ শনিবার সকালে তারা আবার বিক্ষোভ করলে তা দমনে গুলি চালানো হয়৷
২০১৬-১৭ সালে সালে পাঁচজন নিহত
দক্ষিণ চট্টগ্রামে বাঁশখালী উপজেলার সমুদ্র তীরবর্তী গণ্ডামারা ইউনিয়নে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। ১৩২০ মেগাওয়াটের ‘এস এস পাওয়ার প্ল্যান্ট’ নামের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষ বিরোধিতায় নামে। ওই পক্ষটি ও পুলিশের সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধীদের সংঘর্ষে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল প্রাণ ঝরে চারজনের। এছাড়া ১১ পুলিশসহ কমপক্ষে ১৯ জন আহত হন।
নিহতরা হলেন মর্তুজা আলী (৫০), আনোয়ার হোসেন ওরফে আংকুর আলী (৪৫) ও জাকির আহমেদ (৩৫) এবং মো. জাকের (৫৫)। এরপর সেই বিরোধের সমঝোতা বৈঠক ঘিরে ২০১৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আবার দুই পক্ষের সংঘর্ষ নিহত হয় একজন।
সূত্র মতে, সে সময় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষ বিরোধিতায় নামে। সমুদ্র তীরের গণ্ডামারার জমিতে বছরের অধিকাংশ সময় লবণের চাষ হয়। বর্ষায় চিংড়ি এবং বছরে একবার শুধু হয় ধান চাষ। প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য সাত হাজার তিনশ একর আয়তনের গণ্ডামারা ইউনিয়নের ছয়’শ একর জমিই কিনেছে এস আলম গ্রুপ, যা পুরো ইউনিয়নের ১২ ভাগের এক ভাগ।
গণ্ডামারায় তখন ‘ভিটা মাটি রক্ষাকারী এলাকাবাসী’ নামের কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন স্থানীয় একাধিকবারের নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা লিয়াকত আলী ২০১৬ সালের এপ্রিলে অভিযোগ করেছিলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য স্থানীয় ১০ হাজার মানুষকে ভিটে-বাড়ি ছাড়া করার পরিকল্পনা করা হয়।
২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন৷ গত বছর নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি৷
অন্যদিকে এস আলম ও এনএসএন কনসোর্টিয়ামের অভিযোগ ছিল, স্থানীয় রাজনীতিক লিয়াকতকে চাঁদা না দেয়ায় তিনি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের উসকে দেন। এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে আর কখনও গণ্ডামারায় সূর্য উঠবে না, লবণ চাষও হবে না।
২০১৬ সালের ৫ এপ্রিল লিয়াকত আলী বলেছিলেন, বাড়ি ও জমি হারানোর ভয়ে এবং পরিবেশ দূষণের আশঙ্কায় মানুষ প্রতিবাদ করেছে। পুলিশের পোশাক পরে তখন এস আলমের সন্ত্রাসীরা গুলি করেছে।
মরল শ্রমিক আবার তাদের বিরুদ্ধেই মামলা
বাঁশখালীতে পুলিশের সাথে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিকদের সংঘর্ষে ৫ জন নিহতের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। পুলিশ ও মালিকপক্ষ আলাদাভাবে মামলা দুটি করেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বাঁশখালী থানার ওসি শফিউল করিম জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশের মামলায় দুই থেকে আড়াই হাজার শ্রমিককে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
এছাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলা ও প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি নষ্ট করায় এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে আরো একটি মামলা দায়ের হয়। যেখানে ২০ থেকে ২৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
পুলিশ যখন রাষ্ট্রীয় সন্তাসী
গত ২৬ মার্চ ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে পুলিশ গুলি বর্ষণের রেকর্ড করে। দুই ঘণ্টায় তারা গুলি করে ১ হাজার ১০০ এরও বেশি। এরপরের দুদিনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও গুলি ছোড়া হয়। এতে নিহতদের অধিকাংশই নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। কিন্তু দেশের কোনো নাগরিকের ওপরেই আত্মরক্ষা বা অন্যের জীবন বাঁচানোর জন্য বাধ্য না হলে গুলি চালানো সমর্থন করা যায় না।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন ৩৬১ জন৷ গত বছর নিহত হয়েছেন ৪২১ জন, যা আগের বছরের তুলনায় তিনগুণ বেশি৷ এসব ক্রসফায়ারের ঘটনায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাসানোর অভিযোগ আছে৷
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (এফআইএইচআর) হিসাবে ২০০৯ থেকে ১৮ পর্যন্ত গুম হয়েছেন ৫০৭ জন৷ এর মধ্যে ৬২ জনের লাশ পাওয়া গেছে, ১৫৯ জনের হদিস মেলেনি৷ গত ১০ বছরে নিজেদের ৩০০ এর বেশি নেতাকর্মী গুম হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি৷
সবশেষ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ৪,৪২৯টি মামলা করা হয়েছে৷ যাতে চার লাখ ৩৪ হাজার ৯৭৫ জনকে আসামি করা হয় বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি৷ সেখানে এমনকি মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশের উপর ককটেল ছুড়ে মারার মামলা হয়েছে৷ ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে আশি বছরের প্রৌঢ়ের বিরুদ্ধেও৷
রাজনৈতিক সমালোচকেরা বলেছেন, ভিন্নমত দমনের কারণে সরকার পাশ্চাত্যে যেসব সমালোচনার মুখে পড়ে, তা মোকাবিলায় সহিংসতার ঝুঁকিকে বড় করে দেখানোর চেষ্টাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে এসব বিতর্কিত পদক্ষেপের চেয়েও বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ‘আরও শক্তিশালী অস্ত্র’ ব্যবহারের নির্দেশনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের ধারণা করা কখনোই ভালো নয়। বরং এতে উল্টো ফল হতে পারে এবং বৃহত্তর সমাজের মধ্যে তা আরও অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া, গুলি করার আগে অবৈধ জনসমাবেশকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ অনুরোধ জানাবে, তারপর কাজ না হলে জলকামান ব্যবহার করবে। এতে কাজ না হলে লাঠিপেটা করবে। মারমুখী জনতাকে যখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না, তখন নিজের জীবন ও অস্ত্র রক্ষার জন্য গুলি চালাবে। একটি গুলি চালানোর পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলে দ্বিতীয় গুলি চালাবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৫৩০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ