জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে মিয়ানমারে নিহতের সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রবাসী রাজনীতিবিদদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এএপিপি। বৃহস্পতিবার আরও ১১ জন মারা যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত মোট প্রাণ হারালেন ৬০৯ জন।এদিকে অন্তত ছয় আইনপ্রণেতা দেশটির সামরিক সরকারের হাতে আটক হওয়ার ভয়ে সীমান্ত পেরিয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
মিয়ানমারে নিহত ৬০০ ছাড়াল
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে চলা বিক্ষোভে দেশটির সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহতের সংখ্যা বাড়ছেই। প্রায় দুই মাস চলমান এ বিক্ষোভে গতকাল পর্যন্ত মোট ৬০৯ জন নিহত হয়েছেন। বিক্ষোভ-আন্দোলনরত জনতার ওপর নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে এ প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানিয়েছে দেশটির প্রবাসী রাজনীতিবিদদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠন এএপিপি।
সপ্তাহখানেক আগে দেশটির প্রত্যন্ত এলাকার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি সেনা-বিরোধী বিক্ষোভে দেশের গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষের পাশে থাকার বার্তা দেয়ার পর মৃতের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে।
সেনা-পুলিশের গুলি বর্ষণের বিরুদ্ধে নিজেদের তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সকালের দিকে বিক্ষোভকারীরা যখন মিছিলের জন্য জমায়েত শুরু করছেন, প্রায় ছয়টি ট্রাক ভর্তি সেনা সেখানে হাজির হয়। বিক্ষোভকারীরা গাদাবন্দুক, ছুরি আর বোতল বোমা নিয়ে প্রত্যাঘাত করলে আরও পাঁচ ট্রাক বাহিনী আসে। এর পরেই চলে নির্বিচারে গুলি।
সেনা-বিরোধী সিআরপিএইচ জোটের পক্ষ থেকে দেশের প্রাক্তন এক মন্ত্রী জানিয়েছেন, নিজেদের প্রাণ ও অধিকার রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষ প্রত্যাঘাত করবেই।
সেনা-বিরোধী বিক্ষোভকে সমর্থন জানানোয় গোটা দেশে একশোরও বেশি শিল্পীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। পাইং তাকোন নামে বছর চব্বিশের এক অভিনেতাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে সেনারা। তার বোন স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অভিনেতা কয়েক দিন ইয়াঙ্গুনে বাবা-মায়ের বাড়িতে ছিলেন। আজ ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ ৮টি গাড়ি ও ৫০ জন সেনা তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। তাকে কোথায় রাখা হয়েছে, তা তার পরিবার জানে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় একটি শহরে নিরাপত্তাবাহিনীর বিরুদ্ধে শিকারের রাইফেল ও অগ্নিবোমা নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীরা, কিন্তু তার মধ্যেই ১১ জন প্রতিবাদকারী নিহত হয়েছেন।
স্থানীয় গণমাধ্যম মিয়ানমার নাও ও ইরাবতী জানিয়েছে, তেজ শহরের বিক্ষোভকারীদের দমনে প্রথমে সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর ছয় ট্রাক ভর্তি সেনা মোতায়েন করা হয়। বিক্ষোভকারীরা বন্দুক, ছুরি ও বোমা নিয়ে পাল্টা লড়াই শুরু করলে অতিরিক্ত আরও পাঁচ ট্রাক ভর্তি সেনা নিয়ে আসা হয়।
বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে এবং অন্তত ১১ জন প্রতিবাদকারী নিহত ও ২০ জন আহত হন বলে গণমাধ্য দুটি জানিয়েছে।
এ ঘটনায় ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চীর নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সামরিক জান্তা মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করার পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত বেসামরিকের সংখ্যা ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে বলে ভাষ্য অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজোনার্সের (এএপিপি) । বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৫৯৮ জন ছিল বলে জানিয়েছিল আন্দোলনকারী গোষ্ঠীটি।
তেজ শহরের নিকটবর্তী কালে শহরে বুধবার একইরকম সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত ১২ জন নিহত হয় বলে সংবাদ মাধ্যম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য। সু চির সরকারকে ক্ষমতায় পুনর্বহালের দাবিতে বিক্ষোভরতদের ওপর নিরাপত্তা বাহিনী তাজা গুলি, গ্রেনেড ও মেশিনগান ব্যবহার করে বলে এএপিপি জানিয়েছে।
এএপিপির তথ্য অনুযায়ী, এই মুহুর্তে মিয়ানমারে আটক আছেন প্রায় ২৮৫০ বিক্ষোভকারী। গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে আরও কয়েকশ মানুষের বিরুদ্ধে। ইয়াংগুন শহরের বিখ্যাত শিল্পী ও তারকাদের পাশাপাশি জান্তা গ্রেপ্তার করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাবশালী ব্যক্তিদেরকেও।
ভারতে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের ৬ এমপি
গ্রেপ্তারের শঙ্কায় মিয়ানমারের ছয় এমপি ভারতে প্রবেশ করে দেশটির কাছে আশ্রয় চেয়েছেন।
মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কমিটির এক উপদেষ্টার বরাত দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের এক পুলিশ কর্মকর্তা দেশটিতে মিয়ানমারের আইনপ্রণেতাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে বলেছেন, গত ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে আসা এক হাজার ৮০০ জনের মধ্যে তারা রয়েছেন।
তারা ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় মিজোরাম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটির ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সিআরপিএইচ কমিটির উপদেষ্টা বার্তা সংস্থাটিকে বলেন, আইনপ্রণেতারা মিয়ানমারের চিন ও সাগাইং অঞ্চলের বাসিন্দা। তারা রাজ্য ও ফেডারেল আইন পরিষদের সদস্য। তারা ক্ষমতাচ্যুত এনএলডি’র সদস্য। এই দল গত নভেম্বরের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর দেশটির সেনাবাহিনী সেই নির্বাচনকে বিতর্কিত বলে ঘোষণা দেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে এমপিরা মিয়ানমারে খুবই বিপদের মধ্যে আছেন। তাদেরকে খোঁজা হচ্ছে। সেনারা তাদের খুঁজছে।’
প্রথম দিকে, মিয়ানমারের কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে পালিয়ে গেলেও পরে নিরাপত্তারক্ষীদের অভিযান থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষজনও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে মিজোরামে আশ্রয় নিতে শুরু করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের আইনপ্রণেতাদের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ঘটনায় নয়াদিল্লি কূটনৈতিক জটিলতায় পড়তে পারে। কেননা, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে, ভারত প্রকাশ্যে প্রতিবেশী দেশটিতে সাম্প্রতিককালের সংঘাতের বিরোধিতা করেছে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার সংগঠন এএপিপি জানিয়েছে, দেশটিতে কয়েক হাজার আটককৃতদের মধ্যে দেড় শর বেশি এমপি ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রয়েছেন।
রাষ্ট্রদূতকে দূতাবাস থেকে বের করে দিলেন সামরিক অ্যাটাশে
এদিকে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিউ জাওয়ার মিনকে দূতাবাস থেকে বের করে দিয়েছেন তার অধস্তন সামরিক অ্যাটাশে। রাষ্ট্রদূত কিউ এখন আর লন্ডনে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্বও করছেন না বলেও জানিয়ে দেন ওই অ্যাটাশে। কিউ জাওয়ার মিন বলেন, সামরিক অ্যাটাশে অন্য কূটনীতিক ও কর্মীদেরও বেরিয়ে যেতে বলেছেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি অনলাইন এ খবর দিয়েছে।
জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে সংহতি প্রকাশ করেন যুক্তরাজ্যে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত কিউ জাওয়ার মিন। ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী সু চিকে মুক্তিরও দাবি জানান তিনি।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, গত বুধবার লন্ডনের মেফেয়ার এলাকায় দূতাবাসের সামনে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীরা জড়ো হন। সেখানে যোগ দেন রাষ্ট্রদূত কিউ জাওয়ার মিনও। পরে জানা যায়, দূতাবাসে ঢুকতে গেলে কিউকে আটকে দেওয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রদূতকে বরখাস্ত করে উপ-রাষ্ট্রদূত চিট উইনকে লন্ডনের চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। রাষ্ট্রদূতের অনুপস্থিতে চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার দূতাবাসের প্রধান হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন।
এএফপিকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বলেন, সারা রাত তিনি দূতাবাসের বাইরে ছিলেন।
ডেইলি টেলিগ্রাফকে কিউ জাওয়ার মিন বলেন, ‘যখন আমি দূতাবাস থেকে বের হই, তারা ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং তারা দূতাবাস দখলে নিয়ে নেয়।’
রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘তারা নেপিডো থেকে নির্দেশনা পেয়েছে। যার কারণে তারা আমাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না।’ এ বিষয়ে তিনি ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সহিংসতায় ‘নিহতের’ দায় বিক্ষোভকারীদের: মিয়ানমার সেনাবাহিনী
এদিকে সহিংসতায় ‘নিহতের’ দায় বিক্ষোভকারীদের বলে দাবি করেছেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুন। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ দাবি করেন।
জেনারেল জাও মিন তুন বলেন, গত বছর অনুষ্ঠিত হওয়া সাধারণ নির্বাচনে জালিয়াতির তদন্ত করতে তারা আপাতত দেশকে সুরক্ষা দিচ্ছেন। এ কারণেই ক্ষমতা দখল করা। আর এখন অবধি বিক্ষোভে যারা নিহত হয়েছেন, সেটির জন্য আন্দোলনকারীরা দায়ী। তারা বিক্ষোভ না করলে এত প্রাণহানীর ঘটনা ঘটতো না।
গত ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। তার আগে তারা মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চিকে আটক করে। এরপর দুই মাস ধরে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে দেশটিতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ লোক নিহত হয়েছেন। আটক করা হয়েছে কমপক্ষে ২৮৫০ জনকে। শত শত মানুষের বিরুদ্ধে ইস্যু করা হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯১৭
আপনার মতামত জানানঃ