মঙ্গলবার থেকে জাপানী মালিকানার বিশাল মালবাহী জাহাজ ‘এভার গিভেন’ সুয়েজ খালে আড়াআড়িভাবে আটকে পড়ায় মালবাহী জাহাজ চলাচলে তৈরি হয়েছে ভয়াবহ সমস্যা।
জাহাজটি খালের মাঝ বরাবর আটকে যাওয়ায় দুদিক থেকে আর কোনো জাহাজ চলাচল করতে পারছে না। এটির দুই দিকে ৩০০টিরও বেশি জাহাজ আটকে আছে। অনেক জাহাজ আফ্রিকা ঘুরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে।
সুয়েজ খালে আটকে পড়া জাহাজ ‘এভার গিভেন’ আজ রবিবার রাতে সরানো সম্ভব হতে পারে বলে জানিয়েছে জাহাজটির মালিক জাপানিজ প্রতিষ্ঠান শোয়েই কিসেন কাইশা লিমিটেড।- খবর বিবিসির।
‘এমভি এভার গিভেন’ নামে ৪০০ মিটার লম্বা ও ৫৯ মিটার প্রশস্ত, দুই লাখ টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজটি ভূমধ্যসাগরের দিকে যাওয়ার সময় আড়াআড়িভাবে আটকে পড়ে। জাহাজটির মালিকপক্ষ জানিয়েছে, জোরালো বাতাসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জাহাজটি আটকে পড়ে। এতে ওই এলাকায় জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
শোয়েই কিসেনের প্রেসিডেন্ট য়ুকিতো হিগাকি বলেন, অতিরিক্ত সরঞ্জামের মাধ্যমে তারা জাহাজের নিচের পলি সরাতে কাজ করে যাচ্ছেন।
এর আগে শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, টোকিওর স্থানীয় সময় অনুযায়ী শনিবার সন্ধ্যার মধ্যেই জাহাজটি সরানো সম্ভব হবে বলে তারা আশা করছেন।
তিনি বলেন, ‘জাহাজটিতে পানি ঢুকছে না। এটির রাডার ও প্রোপেলারে কোনো সমস্যা নেই। যখন এটি সরানো হবে, এটি চলাচলে সক্ষম হবে।’
তবে জাহাজটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা কোম্পানি বার্নহার্ড শুল্ট শিপম্যানেজমেন্ট (বিএসএম) শুক্রবার জানায়, জাহাজটি সরানোর জন্য একটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
মঙ্গলবার জাহাজটি সুয়েজ খালের তলানির সঙ্গে আটকে যায়। শনিবার প্রায় ২০ হাজার টন বালু উত্তোলন করা হয়। ২০ টি ড্রেজিং টাগবোট এভার গিভেনকে টেনে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ
এদিকে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেন, সুয়েজ খাল পুনরায় খোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানান সাকি।
সুয়েজ খালে জাহাজজটে আটকা পড়া যুক্তরাষ্ট্রের কনন্টেইনারবাহী জাহাজ মের্স্ক ওহায়ওর প্রধান প্রকৌশলী জো রেনল্ডস শুক্রবার বিবিসিকে বলেছেন, খালটির দক্ষিণের প্রবেশমুখে অপেক্ষায় থাকা জাহাজের সংখ্যা ‘দ্রুত বাড়ছে’।
“এটি বিশ্বব্যাপী জাহাজ চলাচলের সময়সূচীতে প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে,” সতর্ক করে বলেন তিনি।
প্রতি ঘন্টায় বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি
লোহিত সাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরকে যুক্ত করেছে সুয়েজ খাল। এই নৌপথের কারণে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্যিক যোগাযোগ সহজ হয়েছে। ১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলপথটিতে তিনটি প্রাকৃতিক হ্রদ আছে। বিশ্বের প্রায় দশ শতাংশ বাণিজ্য পরিবহন এই খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়।
২০২০ সালে সুয়েজ খাল দিয়ে প্রায় ১৯ হাজার জাহাজ চলাচল করেছে। যার অর্থ দিনে গড়ে চলাচল করেছে ৫১.৫টি জাহাজ
পণ্য পরিবহন বিষয়ক জার্নাল লয়েড’স লিস্টের তথ্যমতে, সুয়েজ খালে মালবাহী জাহাজটি আটকে যাওয়ায় প্রতিদিন ৯৬০ কোটি টাকার পণ্য পরিবহন আটকে আছে। এর ফলে প্রতি ঘণ্টায় ক্ষতি হচ্ছে ৪০ কোটি ডলার।
আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করেছে সুয়েজ খাল। লয়েড’স লিস্ট জানায়, এই খালের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫১০ কোটি ডলার ও পূর্ব দিক দিয়ে প্রতিদিন ৪৫০ কোটি ডলারের পণ্য পরিবহন করা হয়।
কয়েক সপ্তাহ সময়ও লাগতে পারে
জাহাজটিকে মুক্ত করার কাজ করছে নেদারল্যান্ডসের বোসকালিস কোম্পানি। এ কাজ করতে কতো সময় লাগবে তা বলার সময় হয়নি বলে এর আগে জানিয়েছিলেন বোসকালিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিটার বেরদোওস্কি।
মিশরের প্রেসিডেন্টের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছেন তিনি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি জাহাজটির কন্টেইনার সরিয়ে এটিকে মুক্ত করতে হয় তাহলে কয়েক সপ্তাহও লেগে যেতে পারে।
ভূমধ্যসগর ও লোহিত সাগরকে যুক্ত করা ১৯৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ খালটি দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ পণ্য পারাপার হয়। এই খালটির কারণেই এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সংক্ষিপ্ততম জলপথ উন্মুক্ত হয়েছে।
এর বিকল্প পথ আফ্রিকা মহাদেশের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যাওয়া, তাতে সুয়েজ খালের চেয়ে আরও দুই সপ্তাহ বেশি সময় লাগে।
জলপথে বাণিজ্যের খাদ্যনালী এই সুয়েজ খাল
১৮৫৯ সাল থেকে ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত লাগাতার পরিশ্রমে তৈরি হয়েছিল এই খাল। ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর এর আনুষ্ঠানিক সূচনা। এই জলপথ তৈরির আগে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় কোনও জাহাজ আসতে গেলে উত্তর আটলান্টিক সাগর হয়ে আফ্রিকা বরাবর ভারত মহাসাগর হয়ে পৌঁছতে হত। এই খালের ফলে উত্তর আটলান্টিক থেকে ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরের মধ্যে দিয়েই অনেক কম সময়েই ভারত মহাসাগরে এসে পড়ে বাণিজ্য জাহাজগুলি।
সুয়েজ খাল তৈরির আগে আফ্রিকা মহাদেশ বরাবর ঘুরে আসতে জাহাজগুলিতে ৮ হাজার ৯০০ কিলোমিটার পথ পেরোতে হত। সময় লাগত ৮ থেকে ১০ দিন। এখন সেখানে এক দিনেই পেরিয়ে যাওয়া যায় সুয়েজ খালের মাধ্যমে। সুয়েজ খালের দৈর্ঘ্য মাত্র ১৯৩ কিলোমিটার।
২০১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, ওই বছর মোট ১৭ হাজার ২২৫টি জাহাজ যাতায়াত করেছিল এই খাল দিয়ে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪৭টি জাহাজ এই খাল পারাপার করেছে।
মিশরের সুয়েজ খাল কর্তৃপক্ষ এই সুয়েজ খালের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন। তবে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই খালের উপর আধিপত্য বজায় রেখেছিল ফ্রান্স এবং ব্রিটেন। ১৯৫৬ সালের পর তা পুরোপুরি মিশর সরকারের অধীন হয়।
২০১৪ সালে মিশর সরকার খালটির প্রস্থ আরও বাড়ানোর কাজ শুরু করে। যাতে এর ধারণ ক্ষমতা দৈনিক ৪৯টি জাহাজ যাতায়াতের থেকে বেড়ে হয় ৯৭টি। এর জন্য খালটির প্রস্থ আরও ৩৫ কিলোমিটার বাড়ানো হয়। এই প্রকল্পের আনুমানিক খরচ হয় ৫৯৪০ কোটি মিশরীয় পাউন্ড।
২০১৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে এই নতুন সুয়েজ খাল চালু হয়। এটা আসলে বাইপাস। এর ফলে খালের চাপ খুব বেড়ে গেলে কিছু কিছু জাহাজ বাইপাস দিয়েও পার করানো হয়। সম্প্রতি সুয়েজ খাল অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর যেমন এই বাইপাস দিয়ে কিছু জাহাজ পার করার কাজ চলছে।
সারা বিশ্বের জলপথে বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ শিপিং কন্টেনার এই খাল দিয়েই যাতায়াত করে। এই খাল দিয়ে সবচেয়ে বেশি মাল রফতানি করে রাশিয়া এবং সৌদি আরব। ভারত এবং চিন সবচেয়ে বেশি মাল আমদানি করে এই পথ দিয়ে।
এসডব্লিউ/এসএস/ ২২১৫
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ