ভাইয়ের সঙ্গে অভিমান করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে (ফেসবুক) ১ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডের ভিডিও বার্তা দেওয়ার পর লক্ষ্মীপুর জজ কোর্ট ভবনের ৫ম তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে রাকিব হোসেন রোমান (২০) নামের এক যুবক। বুধবার দুপুর ১২টায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে শতশত উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় জমান। পরে স্থানীয়রা তার মরদেহ উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নেন।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ। নিহত রাকিব লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের মজুপুর এলাকার বাসিন্দা নুরুল ইসলামের ছেলে ও তার বড় ভাই সোহেলের দোকানের সহযোগী হিসেবে ছিলেন।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীপুর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. মিমতানুর রহমান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করে। তবে তার আত্মহত্যার কারণ এখনো জানা যায়নি। খোঁজ-খবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
এদিকে রোমানের মৃত্যুর খবর শুনে স্বজনদের কান্নায় হাসপাতাল এলাকা ভারি হয়ে উঠে। নিহত রোমান সদর উপজেলার উত্তর মজুপুর গ্রামের নুরুল ইসলামের ছেলে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, রোমান তার বড় ভাই সোহেলের ভাঙারি দোকানে কাজ করতেন। কিছুদিন পূর্বে ভাঙ্গারি দোকান থেকে তামার যন্ত্রাংশ খোয়া যায়। এ নিয়ে বড় ভাই ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে চুরির অপবাদ দিয়ে দোকান থেকে তাড়িয়ে দেয়।
ক্ষোভে-অভিমানে আজ বুধবার জেলা জজ আদালতের ৬ তলা ভবনের ছাদ উঠে ফেসবুক লাইভে আসে রোমান। ফেসবুক লাইভে নিজেকে ‘চোর নয়’ বলে দাবি করে মা-বাবার কাছে ক্ষমা চান তিনি। এসময় নিজের ব্যাংক হিসাব ও গোপন ডিজিট নাম্বার বলেন তিনি এবং নিজের মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় বলেও উল্লেখ করে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন।
ছোট ভাইয়ের আত্মহত্যার খবর শুনে হাসপাতালে এসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বড় ভাই সোহেল। এসময় তিনি আহাজারি করে বলতে থাকেন, ‘এটাই বুঝি আমার শাস্তি ছিল। ব্যবসায়িক কারণে শাসন করার জন্য দোকান থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলাম। তাই বলে সে আত্মহত্যা করবে, এমন ঘটনা ঘটবে জানলে কখনো বলতাম না।’
করোনা মহামারীতে হঠাৎ করেই বেড়েছে আত্মহত্যা। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গেছে আত্মহত্যায় মৃত্যুর সংখ্যা। খোদ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে উঠে এসেছে এমন চিত্র। দেখা গেছে, শুধু বয়স্ক নারী-পুরুষ নয়, অল্পবয়সী এমনকি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ অতিমাত্রায় হতাশাগ্রস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে পড়ায় আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। সব বয়সী মানুষের মধ্যেই বেড়েছে এর প্রবণতা।
আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করেন এমন অনেক মনোবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সামাজিক বৈষম্য, পারিবারিক কলহ, মাদক, ইন্টারনেটের অপব্যবহার, সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা, পারিবারিক বন্ধন ফিকে হয়ে আসার মতো কারণগুলো প্রকট আকার ধারণ করায় মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার মতো জঘন্য অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে। এ ছাড়া নৈতিক স্খলন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্ল্যাকমেইলিং অনেককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকিয়াট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মোহিত কামাল বলেন, ‘মহামারী করোনায় মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়েছে। তায় বিষন্নতায় ভুগছে। নানা রোগে মারা গেলেও মানুষ মনে করেছে করোনায় মৃত্যু হয়েছে। আমাদের ওপর এর প্রভাব পড়ছে। জীবনের অবমূল্যায়ন, চাকরি চলে যাওয়া, বেতন কমে যাওয়া, সন্তান স্কুলে না যাওয়ার কারণে মানুষ হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মানুষ বুদ্ধি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এতে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। বিষন্নতার চরম পরিণতি হচ্ছে আত্মহত্যা। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আত্মহত্যার প্রবণতাও কমে আসবে। সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, পরকীয়া সমস্যা, যৌতুক এসব কারণে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে পরিকল্পনা করেও আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।’
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশে চলমান মহামারীর মধ্যে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণে ৫ হাজার ২০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সে সময় ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর চলমান এক জরিপে চলতি অর্থবছরের ১০ মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের পারসেপশন ছিল যে কভিডের সময় কভিডেই বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, অন্যান্য রোগে কম মারা যাচ্ছে। কিন্তু পরে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আগের অর্থবছরের ১০ মাস এবং এ অর্থবছরের ১০ মাসের তথ্য নিয়ে এ পর্যালোচনা করা হয়েছে।’
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) সূত্র বলছেন, মার্চ ২০২০ থেকে নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন ১ হাজার ৫৮ জন মানুষ। অন্যদিকে ২০১৯ সালের জুন থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২০ এই নয় মাসে এ সংখ্যা ছিল ৯৪০। অর্থাৎ করোনার নয় মাসে আত্মহত্যার হার ১৩ শতাংশ বেড়েছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মহত্যার ঘটনা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ ও প্রয়াস থাকলেও এ প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে প্রচেষ্টাগুলো আরও বেশি মনোযোগ পাওয়ার দাবি রাখে। পাশাপাশি অবকাশ রাখে নতুন ভাবনা ভাবার। শিল্পায়নের সঙ্গে নগরায়ণ, একই সঙ্গে প্রযুক্তিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ায় পাল্লা দিয়ে সমাজ নানা জটিল বাঁক নিচ্ছে। আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধগুলো দিন দিন হালকা হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সামাজিকীকরণ, শক্তিশালী ও কার্যকর সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধসমূহ ধারণ ও লালন, সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হলে তা হবে আত্মহত্যা নিরসনের মূল হাতিয়ার।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৯৪৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগীতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগীতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগীতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
[wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ