রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার লেখক মুসতাক আহমেদ মারা গেছেন। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিনি মারা যান। গত বছরের মে মাস থেকে কারাবন্দী ছিলেন মুসতাক। র্যাবের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার হন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর।
কারা সূত্র জানিয়েছে, মুসতাক কারাগারে মাথা ঘুরে পড়ে যান। সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মোহাম্মদ শরীফ জানান, কাশিমপুর কারাগার থেকে ওই বন্দিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তার মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। ময়নাতদন্ত শেষে তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা সম্ভব হবে।
মুসতাক আহমেদ লালমাটিয়ায় স্ত্রী ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন। তিনি বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান। বাণিজ্যিকভাবে দেশে কুমির চাষের অন্যতম প্রবক্তাও ছিলেন তিনি। পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার সকালে মুস্তাক আহমেদের মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে বলে জানানো হয়েছে। মুস্তাকের স্ত্রী লিপা আক্তার মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন সম্প্রতি। বৃহস্পতিবার পরিবারের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, লিপা মানসিক রোগে ভুগছেন।
গত ১১ জানুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, লেখক মুসতাক আহমেদ ও রাষ্ট্রচিন্তার কর্মী দিদারুল ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। গত বছরের মে মাসে ফেসবুক ব্যবহার করে জাতির জনক, মুক্তিযুদ্ধ, করোনাভাইরাস মহামারি সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র/সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিপ্রায়ে অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি ছড়ানো, অস্থিরতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পাঁয়তারার অভিযোগ আনা হয় আসামিদের বিরুদ্ধে৷ র্যাবের দাবি ‘I am Bangladeshi’ পেইজ থেকে রাষ্ট্রের সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে বিভিন্ন পোস্ট দেওয়ায় পেইজে সম্পৃক্ত কিশোর, মুশতাক, দিদারুলকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
গত সেপ্টেম্বরে এই মামলায় গ্রেপ্তার মিনহাজ মান্নান ও দিদারুল ভূঁইয়া জামিনে মুক্তি পান। কার্টুনিস্ট কিশোর ও লেখক মুসতাকের জামিন হয়নি। ছয় বার মুসতাকের জামিন আবেদন নাকচ হয়। ফলে কারামুক্তি হয়নি এই লেখকের।
এদিকে, কারাগারে থাকা কার্টুনিষ্ট কিশোরও অসুস্থ্য বলে জানালেন তার বড় ভাই আহসান কবীর। তিনি জানান, ২৩ ফেব্রুয়ারি কিশোর, মুসতাকদের ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয়েছিল। কিশোরকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেন। তাকে কিশোর বলেছেন, গ্রেপ্তারের পর নির্যাতন করা হয়েছে, যার কারণে তাঁর পায়ে সংক্রমণ হয়েছে। কানে পুঁজ হচ্ছে। তার ডায়বেটিস বেড়ে ১৮ হয়েছে। চোখেও কম দেখছেন। তার দ্রুত চিকিৎসা দরকার।
রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, গতকাল সন্ধ্যায় কাশিমপুর কারাগারে মুসতাক অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে, কারা কর্তৃপক্ষ তাকে নিয়ে রাত ৮টার দিকে হাসপাতালে যায়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।’
কারাগারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডেপুটি জেলারের বরাত দিয়ে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, সন্ধ্যায় মুসতাক অসুস্থ হয়ে পড়লে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে থাকা মুশতাকের পরিবারের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে পারেনি। তারপর তারা আমার নম্বর যোগার করে ফোন করে। ফোনে ডেপুটি জেলার আমাকে মুশতাকের মারা যাওয়ার সংবাদ দেন।
আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুম বলেন, গতকালও হাজিরা দিতে মুসতাক আদালতে এসেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল তার শরীর খারাপ। কিন্তু জামিন পাননি। তিনি বলেন, মুসতাক যদি গতকালও জামিন পেতেন তাহলে আমাদের হয়তো এই পরিণতি দেখতে হতো না। একজন আইনজীবী হিসেবে যতটুকু বুঝি যে এ মামলায় মুশতাকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সে অভিযোগে জামিন না পাওয়ার কোনো কারণই ছিল না। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি জামিন পেলেন না। এটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এটা হত্যাকাণ্ড।
লেখক মুসতাক আহমেদের মৃত্যুর খবরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠেছে। ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া লিখেছেন, ২৩ ফেব্রুয়ারী সিএমএম আদালতে হাজিরা দিতে এসে যিনি সুস্থ সেই মুস্তাক আহমেদ হটাৎ স্ট্রোক করে ২৫ তারিখ মারা যাবেন তা আমার বিশ্বাস হয় না। কারণ কার্টুনিস্ট কিশোরকে মেরে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেয়া হয়েছে, পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। কানে পুঁজ জমছে অথচ চিকিৎসা নেই। যদি তার স্বাভাবিক মৃত্যুও হয়ে থাকে তবুও এর তদন্ত চাই নিরপেক্ষ কোন কমিটির মাধ্যমে। আগামী সপ্তাহে কার্টুনিস্ট কিশোর ও মুসতাকের হাইকোর্টে জামিন শুনানী হওয়ার কথা ছিল
শফিক আহমেদ লিখেন, কিছু কথা বলতে গিয়েও বলা হল না, কিছু কথা লিখতে গিয়েও লিখা হলো না। আসলে আমাদের দেশটা এখন এমন একটা অবস্থানে চলে গেছে। চোখের সামনে যা যা দেখে যাচ্ছি কিন্তু মুখে বলতে পারছি না। বললে হয়তো মুসতাক আহমেদের মত কারাগারে থেকে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। ছয় বার জামিন আবেদন করেছিলেন, প্রতিবারই নাকচ করা হয়েছিল। আহা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন!
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/৫৯
আপনার মতামত জানানঃ