সুনামগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা দিনদিন ভারী হচ্ছে। আলোচিত ঠিকাদার জিকে শামীমসহ বিভিন্ন প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টতা ও অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা অবৈধ প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার এবং জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এখনো পুরনো হয়নি। এরইমধ্যে শোনা গেল অন্যের জমি দখল করে তিনি গড়েছেন অট্টালিকা।
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিরাট অট্টালিকা বাড়িটি যেখানে নির্মিত হয়েছে, সেখানে ওই এলাকার দুই ব্যক্তির ৬২ শতাংশ জমি রয়েছে। জমির কোনো দাম পরিশোধ না করেই সীমানাপ্রাচীর দিয়ে জায়গা ঘিরে নিয়েছেন এই আইনপ্রণেতা। শুধু বাড়ি বা ফ্ল্যাট নয়, গত ১২ বছরে এই সাংসদের কৃষি-অকৃষি জমিও বেড়েছে বহুগুণ। কিনেছেন দুটি গাড়ি। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো তিনি যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন, তখন এই সাংসদের গ্রামে টিনশেডের পৈতৃক বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না। এখন নিজ গ্রাম, উপজেলা ও জেলায় তিনটি বাড়ি এবং ঢাকার গুলশানে একটি বড় ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এই বাড়ি নির্মাণ করেছেন মোয়াজ্জেম হোসেন সাংসদ হওয়ার পর। এর সত্যতা পাওয়া যায় ভোটের আগে নির্বাচন কমিশনে দেওয়া সাংসদের হলফনামায়। ওই হলফনামায় বাড়িটির কথা উল্লেখ ছিল না।
ওই বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে গাছতলা গ্রামের বাসিন্দা আলতু মিয়ার ৩২ শতক এবং পাইকুরাটি গ্রামের বাসিন্দা বিকাশ রঞ্জন সরকারের ৩০ শতক জমি আছে। স্থানীয়রা জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন এখানে প্রথম একটি টিনশেড ঘর করেন। ২০০১ সালে সাংসদ মোয়াজ্জেম তার এক বোনের জন্য একটি ঘর করে দেওয়ার কথা বলে প্রথমে ৮ শতক জমি আলতু মিয়ার কাছ থেকে কিনতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার সময় ৩০ হাজার টাকা দেবেন। কিন্তু টাকা দিই-দিচ্ছি করে আর দেননি তিনি। সাংসদ হওয়ার পর একটি সীমানাপ্রাচীর দেন। আর এতে আলতু মিয়ার বাকি ২৪ শতাংশ জমিও সীমানাপ্রাচীরের ভেতর ঢুকে যায়।
আলতু মিয়া ওই দৈনিককে বলেন, ‘যখন বুঝতে পারি কিনতে নয়, দখল করতে চান মোয়াজ্জেম হোসেন, তখন বিষয়টি নিয়ে এলাকায় একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। ভুয়া দলিল তৈরি করে এসব জমি নামজারি করে নেন সাংসদের লোকজন। ২০০৮ সালে মামলা করলে আদালত রায়ে ওই নামজারি বাতিল করে দেন।’
এই বিরাট অট্টালিকার ভেতরে বিকাশ রঞ্জন সরকারেরও জমি রয়েছে। পেশায় ব্যাংকার বিকাশ রঞ্জন এখন বসবাস করেন ধরমপাশা উপজেলা সদরে। তিনি বলেন, সাংসদের বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের ভেতরে তার যে জমি রয়েছে, সেটির দাগ নম্বর ১৭৫১। এ ছাড়া সাংসদের দুই ভাইয়ের নামে আরও ২ একর ৬৫ শতক জমি তিনি দলিল করে দিয়েছেন। কিন্তু কোনো টাকা পাননি। সম্পর্কের খাতিরে তিনি এ নিয়ে কখনো দেনদরবার করেননি।
বিকাশ রঞ্জন সরকার বলেন, ‘আসলে উনি (সাংসদ) কথা দিয়ে কথা রাখেননি। নানা কারণে সবকিছু বলাও যাবে না। আমি রেজিস্ট্রি করে জমি দেব, টাকা পাব, এটাই হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি এখন বিষয়টিকে পাত্তা দিচ্ছেন না। তবে আমি টাকা ছাড়া কখনো জমি রেজিস্ট্রি করে দেব না।’
এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে। তিনি ওই দৈনিককে বলেন, ‘আমি কখনো কোনো অন্যায় কাজ করি না। বিকাশ রঞ্জন সরকার আমার নিজের লোক। তাকে আমি অনেক আগেই জমির টাকা দিয়েছি। তিনি কিছু জমি রেজিস্ট্রিও করে দিয়েছেন। আবার কিছু জমি নাকি সরকারি খাস খতিয়ানে চলে গেছে। এই সমস্যা মিটে গেলে অবশ্যই তিনি বাকি জমি রেজিস্ট্রি করে দেবেন। এটা একেবারে আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়।’
আলতু মিয়ার জমির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন ‘আমি আলতু-ফালতু কাউকে চিনি না। এ নিয়ে কথাও বলতে চাই না।’
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন আইন প্রণেতা হয়েও যখন আইন ভঙ্গ করে জোরজবরদস্তি করে অন্যের জমি দখল করেন, তখন তার এলাকার মানুষজন স্বাভাবিকভাবেই অসহায় হয়ে পড়বেন। সরকারদলীয় সাংসদ হওয়াতে স্থানীয়রা তার বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজও তোলার সাহস করেন না। রীতিমত এলাকাতে ত্রাস সৃষ্টি করে রেখেছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভোট ছাড়া নির্বাচিত প্রতিনিধির জবাবদিহি করার দরকার মনে করেন না বলে যা ইচ্ছা নির্বিঘ্নে করে যাচ্ছেন। এতে দেশে যেমন বাড়ছে ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা তেমনি আইনও হয়ে পড়ছে নাজুক।
এসডব্লিউ/পিএ/কেএইচ/১৬১৫
আপনার মতামত জানানঃ