মীর মোনাজ হক : বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ঠিক প্রথম বছর থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি চত্বরে বই বিক্রির আয়োজন দিয়ে শুরু হয় আজকের এই একুশের বইমেলা। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে যখন সবকিছুই ভাঙ্গাচুড়া আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে নিমজ্জিত সেখান থেকেই শুরু হয় নতুন সৃষ্টির চেতনায় এই বইমেলা। মুক্তিযোদ্ধারা যখন সবে অস্ত্র জমা দিয়ে যে যার কাজে আবার ফিরে যাচ্ছে, ছাত্ররা তাদের বিদ্ধস্ত শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষকদেরকে আবার খুঁজে ফিরছে, একুশের শহীদ মিনার তখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে। আর সেই ধ্বংসাবশেষ এর মাঝখানথেকে গড়ে উঠছে নতুন করে বাংলাভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির শহীদমিনার। ঠিক এমনি এক সময়েই মুক্তধারা পাবলিকেশনের স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জন সাহা ১৯৭২ সনে একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সামনে ৩২ টি বই নিয়ে চট্ বিছানো আঙিনায় বসে বইমেলার আদি পর্ব শুরু করেছিলেন, একথা তিনিও বেশ গর্বভোরেই বর্ণনা করেছিলেন একবার ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় যোগ দিতে এসে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি একাই বইমেলা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বইমেলার আয়োজন শুরু করে বাংলা একাডেমি।
১৯৭৮ তে যখন চিত্তরঞ্জন সাহা প্রথম বিশ্ব বিখ্যাত ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় যোগ দেন তখন হাতে গোনা কিছু বাঙালি ছাত্র জার্মানিতে লেখাপড়া করতেন, সেবায় তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা, দেশ থেকে শ’দুয়েক বাংলা বই নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় যোগ দিতে এসেছিলেন তিনি, আমরা কিছু বাংলাদেশী ছাত্র ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলায় বাংলা বইয়ের প্রদর্শনী দেখে আনন্দে বিহ্বল হয়েছিলাম সেবার, চিত্তরঞ্জন সাহা বললেন মাত্র কিছু বই নিয়ে এতো বড়ো ইউরোপের বইমেলায় এসেছি মূলত বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে, বই বিক্রির জন্যে নয়। তাই উনি অনুরোধ করলেন প্রথম দিনেই যদি সব বই কিনে ফেলি তাহলে বাংলাদেশের স্টলটি খালি হয়ে যাবে তাই শেষ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। আর ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা আসলেও বইবিক্রিরির মেলা নয়, বরং বইয়ের পাঠক-লেখক-প্রকাশকদের মিলন মেলা, তবুও চার দিনের এই মেলার শেষের দিন উপচে পড়া ভীড় বই কেনার জন্যে। আমিও সেদিন বেশ কিছু বই কিনেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। উনি যেদিন দেশে ফিরে যান তখন একটা বই কেনার লিস্ট তাঁর হাতে দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম বইগুলো পাঠাতে, বইয়ের মূল্য ও ডাকমাশুল ব্যাঙ্কের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। তিনি যথাযত ফিরে গিয়েই আমাকে ৪ প্যাকেট বই পাঠিয়েছিলেন। সেই থেকেই চিত্তরঞ্জন সাহা আমার একজন আপন জন হয়ে উঠেছিলেন। চিত্তরঞ্জন সাহার সাথে আমার পত্র যোগাযোগ সেই বই মেলের শুরু থেকেই। তিনি আমাকে বই পাঠাতেন নিয়মিত, সুদূর ইউরোপে বসে নতুন বইয়ের প্যাকেট খুলতে যে কি আনন্দ তা একমাত্র যারা পোস্ট প্যাকেটে বই কেনেন তারাই জানেন।
ঢাকার একুশে বইমেলা দেখতে দেখতে গত পঁয়তাল্লিশ বছরে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। তবে এখন একুশে বইমেলা আর প্রকাশকদের নিয়ন্ত্রণে নেই, বাংলা একাডেমি তার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। অর্থাৎ একুশে বইমেলা এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। বইমেলা পরিচালনায় বাংলা একাডেমির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক উঠেছে । অমর একুশে গ্রন্থমেলা পরিচালনা করা বাংলা একাডেমির কাজ নয়, এটা ছেড়ে দেয়া উচিত প্রকাশকদের তত্ত্বাবধানে- এমন কথা বলছিলেন বিশিষ্টজনদের অনেকেই।
বইমেলার পথিকৃৎ হিসাবে চিত্তরঞ্জন সাহার ভূমিকার কথা আজ হয়তো অনেকেরই অজানা। মুক্তিযুদ্ধ কালে অন্য দেশে আশ্রিত অবস্থায় চিত্তরঞ্জন সাহা শুরু করেছিলেন ‘মুক্তধারা’ নামে তাঁর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা। ঐ সময়ে দেশের বাইরের অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে থেকে এমন একটি উদ্যোগ নেয়া যে কতটা বীরত্বব্যঞ্জক ব্যাপার তা হয়তো আজকের সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে আমরা যথার্থ ভাবে অনুভব করতে পারব না। কিন্তু এ কথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, দেশের প্রতি শুধু এইটুকু অবদানের জন্যও চিত্তরঞ্জন সাহা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আপনার মতামত জানানঃ