মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতের উল্লেখযোগ্য শ্রমবাজার দীর্ঘ আট বছর ধরে বন্ধ। সম্প্রতি ওই দেশ ভিজিটরদের অ্যালাউ করেছে। ভ্রমণে (ভিজিট ভিসায়) গিয়ে দেশটিতে কাজের সন্ধান করছেন বাংলাদেশীরা। শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্রমণে আসা ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ ভিসার ধরন পরিবর্তন করে কাজের ভিসা নিচ্ছেন। যারা যাচ্ছেন তাদের অনেকেই কাজ পাবেন না। নানা ঝামেলায় পড়তে হবে। এমনকি আরব আমিরাতের শ্রমবাজারটি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থেকে যায়।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো: শামসুল আলম বলেন, ২০১২ সাল থেকে ওয়ার্ক ভিসায় দেশটি কাউকে নেয়নি। সম্প্রতি ওই দেশ ভিজিটরদের অ্যালাউ করেছে। ভিজিট ভিসায় দেশটি যাওয়ার পরে ওয়ার্ক ভিসায় পরিবর্তনের সুযোগ আছে। একটু ঘুরিয়ে যাওয়ার যেহেতু সুযোগ হয়েছে, আশপাশের দেশগুলো থেকেও এভাবে লোক যাচ্ছে। এই সুযোগটা তো আমাদেরও হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। আরব আমিরাতের বাংলাদেশ মিশনের অ্যাটাচটেডের পর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিচ্ছে। এরপর আমরা ক্লিয়ারেন্স দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
এদিকে, আমিরাতের ভ্রমণ ভিসার সহজলভ্যতা ও ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির দালাল চক্র বিছিয়েছে প্রতারণার জাল। কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে ভ্রমণ ভিসা।
আরব আমিরাতের বিভিন্ন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির তথ্যমতে, ৩০ দিনের জন্য প্রত্যেক ভ্রমণকারীর ভিসা বাবদ লাগে মাত্র ১০-১৩ হাজার টাকা। ৯০ দিনের ভিসার জন্য খরচ পড়ে ডিপোজিটসহ মাত্র ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু দালাল চক্র ও কিছু অসাধু এজেন্সি মিলে ‘সরাসরি কন্ট্রাক্ট’-এর নামে ভিসাপ্রত্যাশীদের থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
গত সপ্তাহে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের বদরুল আলম ভ্রমণ ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে পা রাখেন। তিনি জানান, দেশে দৈনিক আয় হতো ২০০ থেকে ৭০০ টাকা। আপন ভাই আবুধাবি থাকার সুবাদে ভ্রমণ ভিসার সুযোগ নেন। ত্রিশ দিনের ভ্রমণ ভিসা ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি মিলে তার খরচ হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। এত খরচ তবুও ভ্রমণ ভিসায় কেন জানতে চাইলে বদরুল বলেন, ‘সিলেটের রুহুল ট্রাভেলসে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা জমা করে ভিসা নিয়েছি। বাকি টাকা টিকিট করতে গেছে। ভাই বলেছে কাজের সুযোগ আছে। বাকিটা আল্লাহ জানেন।’
কমিউনিটির নেতারা দাবি করছেন, ভ্রমণে আসা ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশ ভিসার ধরন পরিবর্তন করে কাজের ভিসা নিচ্ছেন। তবুও অতিমাত্রায় ভ্রমণ ভিসা গ্রহণ, সুযোগের অপব্যবহার ও মেয়াদ শেষে অবৈধ হয়ে যাওয়া ভ্রমণকারীদের নিয়ে ভবিষ্যতে ঝুঁকি বাড়তে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ও বিএমইটি সূত্রে জানা যায়, সৌদি আরবের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে ২০১২ সালের পর বাংলাদেশের শ্রম ভিসা বন্ধ করে দেয় আরব আমিরাত। ‘খুলবে-খুলছে-খোলা হচ্ছে’ এভাবেই ৮টি বছর পার হয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ থাকা এই শ্রমবাজারে সম্প্রতি অননুমোদিত তথা ভিজিট ভিসায় কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সর্বশেষ গত ৩ ফেব্রুয়ারি মেসার্স ব্রিটেইন ট্রেড সিস্টেম (আরএল ৩৮৯) নামের একটি রিক্রুটিং এজেন্সিকে ৫০০ জন কর্মী নিয়োগের অনুমতি দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
আরব আমিরাতের মোহাম্মদ আব্দুল মহসিন আল-খারাফি অ্যান্ড সন্স এলএলসি নামের কোম্পানির অধীন ট্যাক্সি চালক পদে (পুরুষ) ২০০ জন, জেনারেল লেবার হিসেবে ১০০ জন এবং টাউয়াসুল ট্রান্সপোর্ট এলএলসি নামে কোম্পানির অধীন ট্যাক্সিচালক পদে ২০০ জন কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর আগে গত ২৬ জানুয়ারি সরকার ইন্টারন্যাশনাল (আরএল ১৭১৫) নামে রিক্রুটিং এজেন্সিকে দুবাইর বিভার গাল্প কোম্পানিতে কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার হিসেবে এক হাজার, গত ১৭ জানুয়ারি আল সৌরভ ওভারসিজ (আরএল ১০২৮) নামের রিক্রুটিং এজেন্সিকে সেনসেবল স্টার ক্লিনিং সার্ভিস এলএলসি কোম্পানির অধীন ক্লিনার পদে ২০০ জনের এবং তারও আগে সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল (আরএল ৪৯২) নামের রিক্রুটিং এজেন্সিকে ক্লিনার পদে ২০০ জন কর্মী নিয়োগের অনুমতি দেয় প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
বিএমইটি’র সূত্র জানায়, ১৯৭৬ সাল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এ পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৯৮ জন কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে দেশটিতে চাকরি লাভ করেছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৭৩৯ জন। ২০১২ সালে দেশটিতে গিয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন কর্মী। ওই সাল থেকেই দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ বন্ধ রয়েছে। তবে পরবর্তীতে হাতে গোনা কিছু কর্মী গেছে দেশটিতে।
শ্রমবাজার ও প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রামরুর চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের অবস্থাটা এ রকম, যেসব দেশ লোক নিচ্ছে তারা বিভিন্ন ধরনের এই রকম অন্যায়গুলো করছে। ভিজিট ভিসা দিয়ে নিয়ে বলছে আমরা কাজ দেবো। এই যে জিনিসটা, এটা ওই দেশের এমপ্লয়াররা এক ধরনের অন্যায় করছে। এটা করতে পারে না। তাকে তো সরকারের কাছ থেকে প্রসেস করেই নিতে হবে। আমাদের দেশ থেকে এটাকে ডিসকারেজড (নিরুৎসাহিত) করা দরকার। কারণ ওখানে গিয়ে হয়তো বা ২০ ভাগ চাকরি পাবে, বাকি ৮০ ভাগই কোনো না কোনো ঝামেলায় পড়বে। সেই জায়গা থেকে আমাদের এটা নিরুৎসাহিত করা দরকার। সম্প্রতি ভিয়েতনামে আমাদের অভিজ্ঞতা যেটা হয়েছে, এইভাবে পাঠিয়ে অনেকের চাকরি হয়নি। সুতরাং আমাদের ভাবতে হবে। আরেকটা হচ্ছে, যারা ট্র্যাভেল এজেন্সির মাধ্যমে যাচ্ছে তাদের ধরবে কে, এদের দ্রুত ধরা উচিত। ট্র্যাভেল এজেন্সি যাদের পাঠাবে তারা কখনই চাকরি পাবে না। এরাই কিন্তু পুরো মার্কেটটা খারাপ করে দেবে। এই ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোর অনেকেই কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে যুক্ত। যারা পাঠাচ্ছে ট্র্যাভেল এজেন্সি, তাদের রিক্রুটিং এজেন্সির সাথে যোগাযোগ আছে কি না, সরকারকে তা খতিয়ে দেখা দরকার।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিচালক (বহির্গমন) মো: রেজাউল করিম বলেন, আরব আমিরাতে ওয়ার্কিং ভিসা বন্ধ রয়েছে। কয়েকটি কোম্পানি ওয়ার্ক অর্ডার নিয়ে এসেছে। এগুলো প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে বিএমইটি অনুমোদন দিয়েছে। যেহেতু ওয়ার্কিং ভিসা বন্ধ তাই তারা ভিজিট ভিসায় যাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে আমিরাতে যে বাংলাদেশ মিশন রয়েছে তারা অবগত, সে দেশের সরকারও অবগত। ওখানে গিয়ে তারা ওয়ার্কিং ভিসা নিচ্ছেন। আরব আমিরাত সরকারও ওয়াকিফহাল, ভিজিট ভিসায় নেয়ার পরে ওয়ার্কপারমিট দিয়ে দিচ্ছে। যারা গেছে এখন পর্যন্ত ভালো আছে। কেউ সমস্যায় পড়েছে বলে জানা নেই। এই সুযোগে ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো ভিজিট ভিসায় শ্রমিক পাঠাচ্ছেন এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, এটা আমার জানা নেই। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে অবগত কি না তাও জানা নাই।
আবুধাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ইফতেখার হোসেন বাবুল বলেন, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শ্রমবাজারের জন্য এটি ইতিবাচক দিক। তবে একটি ক্ষুদ্রতম অংশ থেকে যাচ্ছে, যারা ভ্রমণ ভিসার মেয়াদ শেষ করে অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। এই সংখ্যা বাড়তে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। ভ্রমণ ভিসাধারীদের আমিরাতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের ব্যাংক ডিপোজিট রাখা এবং ভিসা পরিবর্তন না করলে বা দেশে ফেরত না গেলে শর্তসাপেক্ষে এই টাকা কেটে নেওয়ার নিয়ম করলে অবৈধ হওয়ার পরিমাণ যেমন কমবে, তেমনি দালালদের দৌরাত্ম্য কমতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশিষজ্ঞরা বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে আরব আমিরাতের শ্রমবাজারটি চালু হয়নি। আমরা দেখছি যে, গত বছর (শেষ দিক) প্রচুর লোক ট্যুরিস্ট ভিসায় আরব আমিরাতে যাচ্ছে। ট্যুরিস্ট ভিসায় গিয়ে তো আর কাজ করা যায় না। এর ফলে আমাদের যে স্বাভাবিক শ্রমবাজার সেটাও নষ্ট হবে; আবার এই লোকগুলো পরে আনডকুমেন্টেড হয়ে পড়বে। প্রতিদিনই যেসব ফ্লাইট যাচ্ছে তা ট্যুরিস্ট যাত্রীতে ভরে যাচ্ছে, এই বিষয়ে আরো সচেতন হওয়া উচিত। আসলেই যদি শ্রমবাজারের চাহিদা থেকে থাকে তাহলে সেটা স্বাভাবিকভাবে সমস্ত প্রক্রিয়া মেনে তারপর পাঠানো উচিত। অন্যথায় ভবিষ্যতে বাজারটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যারা ট্যুরিস্ট ভিসায় যাচ্ছে তারা তো সরকারের রেজিস্টারে আসছে না। ফলে এরা যদি মারা যায় বা কোনো বিপদে পড়ে তখন কিন্তু ক্ষতিপূরণ-কোনো কিছুই পাবে না। তারা আনডকুমেন্টেড থেকে যাবে। সুতরাং নিজেদের বা শ্রমবাজারের স্বার্থেই এসব করা উচিত নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ