পদ্মার তীরবর্তী জমিজামা বাড়িঘর পদ্মার গর্ভে চলে যায় বলে তাকে সর্বনাশী পদ্মা বলে ডাকা হয়। কেবল পদ্মাই যে মানুষের জমিজামা বাড়িঘর গিলে খায় তা নয়, নদী ভাঙ্গন দেশের অনেক নদীতেই হয়ে থাকে। এনিয়ে স্থানীয় জনমনেও আতঙ্কে থাকে। নদী ভাঙ্গনের মাধ্যমে মানুষের জমিজামা ঘরবাড়ি গিলে ফেলার কথা প্রচলিত হলেও এবার নদীই পড়েছে সেই সংকটে। গোটা নদীকেই গিলে ফেলার পাঁয়তারা চালাচ্ছে নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠী। মেঘনা নদী গিলে ফেলা নিয়ে আলোচনায় চলে এসেছে মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ।
দিনে দিনে ‘ভয়াল দানব’ হয়ে উঠেছে মেঘনা গ্রুপ। গ্রুপটির চোখের সামনে যা পড়ছে তা-ই গিলে খাচ্ছে। ফসলি জমি, ভিটেমাটি, খাসজমি, খাল, নদী কোনো কিছুই বাদ পড়ছে না। সবই তার বিশাল বপুর পেটে ঢুকে যাচ্ছে অনায়াসে। নিজের শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে এরই মধ্যে কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম নিশ্চিহ্ন করেও ক্ষান্ত হয়নি মেঘনা গ্রুপ। চুরি করে নিয়েছে মেঘনা নদীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও যার বুক চিরে বয়ে গেছে দেশের প্রধান নদীর একটি মেঘনা নদী। কিন্তু বর্তমানে সরেজমিনে দেখলে হতাশায় কাতর হয়ে বলতে হবে এ যেন রুপকথার গল্প। দিন দিন যেন হারিয়ে যাচ্ছে সোনারগাঁও নামের সার্থকতা। সোনারগাঁয়ের এ কলংকের রুপকার হচ্ছে মেঘনা গ্রুপ। মেঘনা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মেঘনা গ্রুপের থাবায় যেন হারাতে বসেছে সেই বহমান স্রোতধারার মেঘনা নদী।
আলাদিনের চেরাগে ভর করে মেঘনা নদী দখল ও ভরাটের উৎসবে যেনো মাতোয়ারা মেঘনা গ্রুপ। একের পর এক কারখানা স্থাপনের নামে চলছে নদী দখল ও ভরাট। চোখের সামনে যা দেখছে তাই গিলে হজম করে ফেলছে মেঘনা গ্রুপ। দখলের এই প্রতিযোগিতায় বাদ যাচ্ছে না কৃষকের ফসলি জমি, ভিটে মাটি, সরকারি খাল, সওজের জমি। এলাকার কিছু বালু খেকোদের সহযোগিতায় জোড়পূর্বক চলছে দখলের কাজ। শুধু জমি দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি প্রতিষ্ঠানটি শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্যে নদীটিকে মেরে ফেলার খেলায়ও মেতেছে। এতে অস্তি¡ত্ব সংকটে আছে মেঘনা নদী।
মেঘনা গ্রুপের নদী চুরি নিয়ে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। এ ঘটনা নিয়ে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে খবর প্রকাশিত হয়। মেঘনা গ্রুপের নদী দখলের বিষয়টি তোলপাড় তুলেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গঠিত ১২ সদস্য তদন্ত কমিটি দীর্ঘ দুই বছর সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদনটি গত ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের ওই প্রতিবেদনে নানা তথ্য উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই শিল্পগ্রুপ বছরের পর বছর প্রভাব খাটিয়ে ও মিডিয়া ব্যবহারের মাধ্যমে নদী গিলে ফেলেছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে গিয়ে মেঘনা গ্রুপের ৭টি প্রতিষ্ঠান প্রবাহমান মেঘনা নদীর ২৪১ দশমিক ২৭ একর জমি অবৈধ দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৭৭ একর নদীর জমিতে মূল ভবন নির্মাণ করেছে তারা। আবার ৫ দশমিক ৫ একর জমিতে নির্মাণ করেছে নিজস্ব রাস্তা। অবৈধভাবে দখল করা এসব জমি এক মাসের মধ্যে উদ্ধার করে নদীর প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, বিআইডব্লিউটিএ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এছাড়া নদী রক্ষায় ব্যর্থ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করেছে জাতীয় নদী কমিশন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে মেঘনা শাখা নদী মারাখালী নদীর অংশের উত্তর ও দক্ষিণ অংশের পাড় থেকে নদীর ভেতরে প্রায় দুই কিলোমিটার পর্যন্ত দখল করার অভিযোগ উঠেছে। মেঘনা নদীর অন্তত ৩০০ বিঘা জমি দখল করেছে মেঘনা গ্রুপ। দখলকৃত স্থানে ইতোমধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে মেঘনা গ্রুপের মালিকানাধীন ফ্রেস টি ফ্রেস সুগার মিলস, পেপার মিলস, কেমিক্যাল ফ্যাক্টারিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান। ভূমি দস্যুতার এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই মেঘনার পারিবারিক প্রতিষ্ঠানগুলোও। গ্রুপের ভাগ্নিজামাই বলে পরিচিত আল মোস্তফার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও নদী দখল করে ব্যাগের কারখানা গড়ে তুলেছেন। যা বিগত ২০১০ সাল থেকে ধাপে ধাপে এবং একটু একটু করে এসব জমি দখল করে নেয়া হয়। মেঘনা গ্রুপের এমন অবৈধ দখলে ভরাট হওয়ায় সাধারণ গতিপথ হারাতে বসেছে প্রবাহমান মেঘনা। নদী ডাকাতির এক কর্মকাণ্ডে অস্তিত্ব সংকটের হুমকিতে আছে আশেপাশের নদী সংলগ্ন বিভিন্ন নিচু এলাকা ও চরের জমিগুলো। আনন্দবাজার এলাকায় মেঘনা নদীর প্রায় ৫০০ ফুট জায়গা দখল করে মাটি ভরাট করেছে মেঘনা গ্রুপ এবং প্রায় ৫০ একর জমি দখল করে নিয়েছে। পিরোজপুর ইউনিয়নের ছয়হিস্যা জৈনপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০০ বিঘা জমি গ্রাস করেছে। আষাড়িয়ার চড় ও ঝাউচর এলাকায় নদীর অধিকাংশ বালু ভরাট করেছে। নদীর প্রায় ৭০০ ফুট দখল করে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করেছে মেঘনা গ্রুপ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় বালু ভরাটে চলছে নদী ভরাট। এমনকি টাকার জোড়ে জাল দলিলের মাধ্যমে উপজেলা ভূমি অফিসকে কাঠের চশমা পরিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে শত শত কৃষকের জমি, মেঘনা সহ আশেপাশে থাকা শাখা নদী। মেঘনা গ্রুপ বেশির ভাগ জমিই অবৈধভাবে দখল করে গড়ে তুলছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা। প্রশাসনের নাকের ডগায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিনে দুপুরেই চলে নদী দখল।
স্থানীয় সূত্রে আরো জানা যায়, বিভিন্ন সময় নদী দখল ও জমি ভরাটের বিরুদ্ধে একাধিবার বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন করেও প্রশাসন থেকে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। উল্টো এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে বিভিন্নভাবে প্রশাসনিক ফোর্স দিয়ে হয়রানি করা হয়।
আরো জানা যায়, প্রাচীন বাংলার এই রাজধানীর প্রায় চারদিকেই মেঘনা গ্রপের দখল থাবা। যা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মেঘনা নদীর সাথে সংযুক্ত বিভিন্ন শাখা নদীগুলো। নদী সহ অবৈধভাবে দখল করছে পরিবেশের জন্য অপরিহার্য খাল-বিল, ফসলি জমি। তাদের অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নদী ও খালের পানিতে মিশে নষ্ট হচ্ছে পানির ভারসাম্যতা। ফলস্বরূপ বিলুপ্ত প্রায় মৎস্য প্রাণী।
ওই জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বলেন, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনটি আমরা এখনো পাইনি। তবে গত ২৮ জানুয়ারি জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সাথে এ বিষয়ে সভা হয়েছে। মেঘনা গ্রুপের নদী দখল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছি। নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সোনারগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতিকুল ইসলামের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক স্যারের নির্দেশে মদিনা গ্রুপের দখলে থাকা নদী ও নদীর তীরবর্তী সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকাই নয়, অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের দখলের তালিকা করে জেলা প্রশাসকের নির্দেশক্রমে নদীর জায়গা উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
মেঘনা গ্রুপের দখলে থাকা নদীর জায়গা দখলমুক্ত করতে একাধিকবার অভিযান শুরু হলেও মাঝপথে তা আটকে গেছে। এরপর আর সেখানে অভিযান পরিচালিত হয়নি। এতে করে অন্যান্য দখলদাররাও ছাড় পেয়ে গেছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কমিশনের সুপারিশ মোতাবেক এক্ষুণি ব্যবস্থা নিতে না পারলে দখলদারদের কবল থেকে নদী উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে মেঘনা নদীর ক্ষেত্রে এটি আরো কঠিন হবে। কারণ এর আগে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে মেঘনা নদী দখলদকারি মদীনা গ্রুপের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে মেঘনা গ্রুপের দখলকৃত নদীর জায়গা উদ্ধার করা হয়নি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ