১৯৯০ সালের শীতের এক সকালে ঢাকা শহর ছিল থমথমে। রাজপথে মানুষের ভিড়, বাতাসে উত্তেজনা, দেয়ালে দেয়ালে লেখা স্লোগান—স্বৈরাচার পতনের ডাক। সেই ভিড়ের মাঝখানে, দৃশ্যত নীরব কিন্তু রাজনৈতিকভাবে প্রবল উপস্থিতি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক নারী। তিনি তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় নেই, সেনাবাহিনী নেই, প্রশাসন নেই—আছে শুধু জনতার প্রত্যাশা আর নিজের অদম্য অবস্থান। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সেই গণআন্দোলনের মুহূর্তে খালেদা জিয়া হয়ে উঠেছিলেন এক প্রতীক। যেন ঝড়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক দীপশিখা—নেভে না, বরং দিকনির্দেশ দেয়।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন বোঝার জন্য তাঁকে কেবল একজন প্রধানমন্ত্রী বা বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে দেখলে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তিনি ছিলেন ইতিহাসের সন্তান—বাংলাদেশের সবচেয়ে অস্থির, সংঘাতমুখর ও মেরুকৃত সময়গুলো তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে। তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ কোনো পরিকল্পিত ক্যারিয়ার ছিল না; এটি ছিল ইতিহাসের এক নির্মম ধাক্কা।
১৯৮১ সালের ৩০ মে। চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যু নয়, এটি ছিল ক্ষমতার ভারসাম্যে এক ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে উঠে এলেন খালেদা জিয়া—একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী, যাঁর কোনো সক্রিয় রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু ইতিহাস অনেক সময় প্রস্তুত মানুষ খোঁজে না, প্রয়োজনের মুহূর্তে কাউকে টেনে তোলে। বিএনপি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছিল, আর সেই শূন্যতায় খালেদা জিয়া হয়ে উঠলেন উত্তরাধিকার ও সম্ভাবনার মিলনবিন্দু।
১৯৮১ সালের মে মাসেই তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন হন। তখনকার রাজনীতি ছিল পুরুষশাসিত, সামরিক প্রভাবিত ও নিষ্ঠুর। এই পরিবেশে একজন নারী নেত্রীর টিকে থাকাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু খালেদা জিয়া দ্রুত বুঝে যান—রাজনীতিতে আবেগ নয়, অবস্থানই মূল শক্তি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি আপসহীন কৌশল বেছে নেন। গ্রেপ্তার, গৃহবন্দী, দমন-পীড়ন—সবকিছু সত্ত্বেও তিনি রাজপথ ছাড়েননি। এই সময়েই তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের সবচেয়ে শক্ত রূপটি তৈরি হয়—“আপসহীন নেত্রী”।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের প্রথম বড় বিজয়। এরশাদের পতনের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে, আর খালেদা জিয়া পরিণত হন গণতান্ত্রিক রাজনীতির কেন্দ্রীয় মুখে। এই সময় তিনি ছিলেন ঠিক যেন দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা একটি নদীর মুখ—যেখানে জমে থাকা ক্ষোভ, প্রত্যাশা ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা একসঙ্গে প্রবাহিত হয়।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির বিজয় তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী করে তোলে। এই বিজয়ের চেয়েও ঐতিহাসিক ছিল তাঁর সরকারের একটি সিদ্ধান্ত—সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা থেকে সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন ছিল ক্ষমতা সীমিত করার সাহসী পদক্ষেপ। ক্ষমতা হাতে পেয়েই ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দেওয়া—বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটি বিরল উদাহরণ।
তবে ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় সংঘাত। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই সময় থেকেই ক্রমশ রূপ নেয় শত্রুতায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচন, আন্দোলন, হরতাল ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদকে বিতর্কিত করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে হয় তাঁকে। এই পরাজয় তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শেষ ছিল না; বরং এটি তাঁকে আরও কঠোর করে তোলে।
২০০১ সালে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন—এবার আরও শক্ত অবস্থানে। এই সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার রাষ্ট্র চালায়। অর্থনীতি ও অবকাঠামোয় কিছু অগ্রগতি হলেও এই মেয়াদে সবচেয়ে বড় ছায়া হয়ে থাকে জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতির অভিযোগ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ভয়াবহ অধ্যায়। এই ঘটনা শুধু মানবিক ট্র্যাজেডি নয়, বরং রাজনীতির নৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়। এই সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে পড়ে, কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ভাঙেনি।
২০০৭ সালে আসে আরেক ঐতিহাসিক মোড়। জরুরি অবস্থা জারি হয়, রাজনীতি কার্যত সামরিক-সমর্থিত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হন, তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়। এই সময় তাঁর রাজনৈতিক জীবন যেন এক দীর্ঘ শীতকাল—নিঃসঙ্গ, কঠিন ও নিষ্ঠুর। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি তাঁর জন্য ছিল বড় ধাক্কা।
পরবর্তী এক দশক তাঁর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। আন্দোলন ব্যর্থতা, নির্বাচন বর্জন, কারাবাস, অসুস্থতা—সব মিলিয়ে খালেদা জিয়া রাজনীতির মাঠে শারীরিকভাবে অনুপস্থিত হলেও প্রতীকীভাবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি হয়ে ওঠেন যেন এক নীরব মেরুদণ্ড—যাকে দেখা যায় না, কিন্তু যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি রাজনৈতিক দল।
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের মূল সুর ছিল দ্বন্দ্ব। তিনি কখনো আপসের রাজনীতি করেননি। এই বৈশিষ্ট্য তাঁকে সমর্থকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করেছে, আবার দেশকে দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থার দিকেও ঠেলে দিয়েছে—এ অভিযোগও অস্বীকার করা যায় না। তিনি ছিলেন আগুনের মতো—উষ্ণতা দেন, আবার পোড়ানও।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল ব্যতিক্রমী। একজন নারী হিসেবে তিনি শুধু ক্ষমতায় যাননি, ক্ষমতা ধরে রেখেছেন, হারিয়েছেন, আবার লড়েছেন। তাঁর জীবন প্রমাণ করে—বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু আদর্শের লড়াই নয়, এটি সহনশীলতারও পরীক্ষা।
আজ খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনকে ইতিহাসের আয়নায় দেখলে তিনি একক কোনো রঙে ধরা পড়েন না। তিনি একই সঙ্গে শক্ত ও দুর্বল, বিজয়ী ও পরাজিত, জনপ্রিয় ও বিতর্কিত। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক দীর্ঘ ছায়া—যা কখনো রোদে গাঢ় হয়েছে, কখনো সন্ধ্যায় দীর্ঘ হয়েছে, কিন্তু কখনো পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি।
এই কারণেই খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন শুধু একজন নেত্রীর গল্প নয়। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এক অসম্পূর্ণ, সংঘাতমুখর কিন্তু অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস।
আপনার মতামত জানানঃ