চীনের উত্তর প্রান্তরের বিস্তৃত ভূদৃশ্যে, যেখানে আজ মরুভূমি, ঝোপঝাড় আর কৃত্রিম বনায়নের ফাঁকে ফাঁকে আধুনিক সভ্যতার চিহ্ন দেখা যায়, সেখান থেকেই উঠে এলো ইতিহাসের এক বিস্ময়কর স্তর। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সম্প্রতি নিশ্চিত করেছেন, প্রায় ২ হাজার ২০০ বছর আগে নির্মিত একটি বিশাল মহাসড়কের অন্তত ১৩ কিলোমিটার অংশ আজও প্রায় অক্ষত অবস্থায় মাটির নিচে টিকে আছে। এই সড়কটি শুধু প্রাচীন চীনের নয়, বরং সমগ্র মানবসভ্যতার অবকাঠামোগত ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গবেষকদের মতে, এটি ছিল এমন এক সড়ক, যেখানে সেই সময়েই অনায়াসে চার লেনের যান চলাচল সম্ভব ছিল—যা আধুনিক মহাসড়কের ধারণাকে কয়েক হাজার বছর পেছনে নিয়ে যায়।
এই সড়কটির নাম ‘কিন স্ট্রেইট রোড’। ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, চীনের প্রথম সম্রাট কিন শি হুয়াংয়ের সরাসরি নির্দেশে এটি নির্মিত হয়। সম্রাট কিন শি হুয়াং ইতিহাসে পরিচিত একদিকে চীনের একীকরণকারী শাসক হিসেবে, অন্যদিকে কঠোর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বিশাল রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের রূপকার হিসেবে। মহাপ্রাচীর নির্মাণ, অভিন্ন আইন ও মুদ্রা চালু, এমনকি সম্রাটের মৃত্যুর পরের জন্য তৈরি টেরাকোটা সৈন্যদল—সবকিছুর মধ্যেই তাঁর শাসনের এক ধরনের অতিমানবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছাপ পাওয়া যায়। কিন স্ট্রেইট রোড ছিল সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষারই আরেকটি বাস্তব রূপ।
প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল মাত্র পাঁচ বছরে। আজকের যুগেও এমন দৈর্ঘ্য ও পরিসরের মহাসড়ক প্রকল্প শেষ করতে যেখানে এক দশকের বেশি সময় লেগে যায়, সেখানে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এত দ্রুত এই কাজ সম্পন্ন হওয়া বিস্ময় জাগায়। ইতিহাসবিদ সিমা কিয়ানের বর্ণনা অনুযায়ী, ২১২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সেনাপতি মেং তিয়ানের তত্ত্বাবধানে কয়েক লাখ সৈন্য ও সাধারণ মানুষ এই নির্মাণকাজে অংশ নেন। এটি ছিল মূলত একটি সামরিক সড়ক, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উত্তর দিকের যাযাবর দস্যু গোষ্ঠী শিওংনুদের আক্রমণ ঠেকানো এবং সীমান্ত অঞ্চলে দ্রুত সেনা মোতায়েন নিশ্চিত করা।
সড়কটির বিস্তার ছিল তৎকালীন কিন রাজবংশের রাজধানী শিয়ানিয়াং থেকে শুরু করে বর্তমান ইনার মঙ্গোলিয়ার বাওতু শহর পর্যন্ত। এই পথটি পাহাড়, উপত্যকা, মরুভূমি ও সমতল ভূমি পেরিয়ে গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের খননকাজে যে নির্মাণশৈলীর প্রমাণ মিলেছে, তা প্রাচীন চীনা প্রকৌশলবিদ্যার উন্নত স্তরের সাক্ষ্য বহন করে। পাহাড় কেটে সোজা রাস্তা তৈরি করা, নিচু উপত্যকা ভরাট করে সমতল পথ বানানো, মাটির ঢাল শক্ত করতে স্তরভিত্তিক নির্মাণ—এসব কৌশল আধুনিক সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সঙ্গে বিস্ময়কর মিল রাখে। গড়ে ৪০ থেকে ৬০ মিটার চওড়া এই সড়ক ছিল এতটাই প্রশস্ত যে একসঙ্গে একাধিক সামরিক বহর চলাচল করতে পারত।
সম্প্রতি যে ১৩ কিলোমিটার অংশটি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি চীনের শানসি প্রদেশের ইউলিন এলাকায় অবস্থিত। ইউলিন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট গত বছরের জরিপের ভিত্তিতে এই সড়কের অস্তিত্ব নিশ্চিত করে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো, আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা রাস্তার রেখা শনাক্ত করা হয়েছে। মরুভূমি এলাকায় কৃত্রিম বনায়নের ফলে মাটির গঠন ও রঙের যে সামান্য পরিবর্তন হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করেই গবেষকরা প্রাচীন সড়কের অবস্থান চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।
খননকাজের সময় রাস্তার পাশে একটি প্রাচীন ‘রিলে স্টেশন’ বা বিশ্রামাগারের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই ধরনের স্টেশনগুলো ছিল তৎকালীন যোগাযোগ ও সামরিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে সৈন্য ও দূতেরা বিশ্রাম নিত, ঘোড়া বদল করত এবং প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করত। সেখানে পাওয়া সিরামিকের টুকরো ও অন্যান্য নিদর্শনের মাধ্যমে সড়কটির সময়কাল ও ব্যবহার সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
চীনের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রশাসনের মতে, কিন স্ট্রেইট রোড ছিল মহাপ্রাচীরের পর প্রাচীন চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিরক্ষা প্রকল্প। এটি শুধু একটি সড়ক নয়, বরং একটি সামরিক কৌশলগত অবকাঠামো ছিল। দ্রুত সেনা চলাচল, সরবরাহ ব্যবস্থা এবং সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ—এই তিনটি লক্ষ্য পূরণে এই সড়ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে ইতিহাসের নির্মম পরিহাস হলো, যে সড়কটি একসময় শত্রু প্রতিরোধের জন্য তৈরি হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে সেটিই সাম্রাজ্যের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে, উত্তর দিকের যাযাবর গোষ্ঠীগুলো এই প্রশস্ত সড়ক ব্যবহার করেই চীনের মূল ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। ইতিহাসে উল্লেখ আছে, হান রাজবংশের শাসনামলে অন্তত তিনবার এই সড়কের বিভিন্ন অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, যাতে আক্রমণকারীরা সহজে অগ্রসর হতে না পারে। এটি দেখায়, অবকাঠামো যেমন শক্তির প্রতীক, তেমনি ভুল সময়ে বা ভুল প্রেক্ষাপটে তা দুর্বলতার কারণও হয়ে উঠতে পারে।
১৯৭৪ সালে প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রথমবারের মতো কিন স্ট্রেইট রোডের একটি অংশ খুঁজে পান। কিন্তু তখনকার প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে পুরো পথের ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব পুরোপুরি বোঝা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক এই নতুন আবিষ্কার সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ধীরে ধীরে পুরো সড়কপথের মানচিত্র পুনর্গঠন করা গেলে প্রাচীন চীনের সামরিক কৌশল, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমব্যবস্থার ওপর নতুন আলো পড়বে।
এই আবিষ্কার আধুনিক বিশ্বের জন্যও একটি গভীর বার্তা বহন করে। আজকের যুগে আমরা যেসব অবকাঠামোগত সাফল্য নিয়ে গর্ব করি—মাল্টি-লেন হাইওয়ে, দ্রুত নির্মাণ প্রকল্প, বিশাল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ—তার অনেক কিছুর বীজ যে হাজার হাজার বছর আগেই রোপিত হয়েছিল, কিন স্ট্রেইট রোড তার জ্বলন্ত প্রমাণ। একই সঙ্গে এটি মনে করিয়ে দেয়, শক্তি ও উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন না থাকলে সবচেয়ে উন্নত অবকাঠামোও শেষ পর্যন্ত ঝুঁকির উৎস হয়ে উঠতে পারে।
মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা এই প্রাচীন মহাসড়ক তাই শুধু অতীতের এক নিদর্শন নয়। এটি এক ধরনের সময়সেতু, যা আমাদের বর্তমানকে যুক্ত করে সেই যুগের সঙ্গে, যখন মানবসভ্যতা তার সীমা ছুঁয়ে দেখার সাহস করেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকদের হাতে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হওয়া এই পথ আমাদের শেখায়—ইতিহাস কখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায় না, সে অপেক্ষা করে, সঠিক সময় ও চোখের, যা তাকে আবার আলোয় ফিরিয়ে আনবে।
আপনার মতামত জানানঃ