ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান ফারুক হাদি হত্যাকাণ্ডের পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অদৃশ্য আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একজন রাজনৈতিক নেতাকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনা শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, বরং এটি দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সহিংসতার বাস্তব চিত্র নতুন করে সামনে এনেছে। এই ঘটনার পর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ মহল পর্যন্ত সবাই বিষয়টি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হাদির হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
হাদি হত্যার পরপরই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কা কাজ করতে শুরু করে। অনেক নেতা প্রকাশ্যে না বললেও ভেতরে ভেতরে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিশেষ করে যারা মাঠপর্যায়ের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, নিয়মিত গণসংযোগ করেন, জনসভা বা পথসভায় অংশ নেন—তাদের জন্য পরিস্থিতি আরও আতঙ্কজনক হয়ে ওঠে। এই বাস্তবতায় সরকারের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেয়, কোন কোন রাজনৈতিক নেতা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আছেন, তার একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করা হবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশের সবকটি ইউনিট দ্রুত অনুসন্ধান শুরু করে।
গোয়েন্দা তথ্য, মাঠপর্যায়ের রিপোর্ট, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে একটি বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, এই তালিকায় মোট ১২৭ জন রাজনৈতিক নেতার নাম উঠে এসেছে, যারা বর্তমানে উচ্চমাত্রার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই তালিকায় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বাদে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ প্রায় সব বিরোধী ও নতুন রাজনৈতিক দলের নেতাদের নাম রয়েছে। ঢাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতারাও এই তালিকাভুক্ত হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তালিকাটি ইতিমধ্যে সরকারের হাইকমান্ডের কাছে পাঠানো হয়েছে। শুধু নামের তালিকা নয়, কেন ওই নেতারা ঝুঁকিতে আছেন, কোন ধরনের হুমকি রয়েছে, কীভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যেতে পারে—এসব বিষয়ও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, প্রয়োজন অনুযায়ী নেতাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, বাসভবনের নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে।
এই সিদ্ধান্তের পরপরই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে শুরু করেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৭৩ জন নেতা অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। এর মধ্যে বিশেষ বিবেচনায় ২০ জনকে গানম্যানসহ অস্ত্র দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই অনুমোদনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ঝুঁকির মাত্রা, রাজনৈতিক ভূমিকা, পূর্ববর্তী হুমকি ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
পুলিশের তৈরি প্রতিবেদনে জুলাই যোদ্ধাদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির শীর্ষ ও জেলা পর্যায়ের নেতাদের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের নামও তালিকায় রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি এবং তাদের শরিক দলের নেতাদের নাম এই তালিকায় নেই, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।
নিরাপত্তার জন্য যাদের গানম্যান দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী এবং সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা। একই সঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খানসহ আরও কয়েকজন নেতার নাম রয়েছে এই তালিকায়।
নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের তালিকায় শুধু রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাই নন, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী এবং জুলাই যোদ্ধারাও রয়েছেন। ইতিমধ্যে ২০ জন নেতার ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় গানম্যান মোতায়েন করা হয়েছে। পাশাপাশি কিছু নেতার বাসভবনে ইউনিফর্মধারী পুলিশ সদস্য নিয়োজিত করা হয়েছে, যাতে যেকোনো ধরনের হুমকি বা হামলা দ্রুত প্রতিহত করা যায়।
তবে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঝুঁকিতে থাকা অনেক নেতার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। তারা রিকশা, সিএনজি বা ভাড়াকৃত যানবাহনে চলাচল করেন। এমন অবস্থায় তাদের চলাচলের সময় কীভাবে কার্যকর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, তা নিয়ে ভাবনায় পড়েছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। বিকল্প পরিকল্পনা হিসেবে নির্দিষ্ট রুটে মোবাইল প্যাট্রোলিং, সাদা পোশাকে নজরদারি এবং স্থানীয় সোর্স ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করেছে। চোরাগোপ্তা হামলা ঠেকাতে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশি সোর্স বাড়ানো হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা সচল করা হয়েছে এবং সীমান্ত এলাকায় কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ভাড়াটে কিলার ব্যবহার করে রাজনৈতিক মাঠ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম জানিয়েছেন, রাজনৈতিক নেতাদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে। অনেক নেতা আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স চেয়ে আবেদন করেছেন, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে অপরাধীদের ধরতে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, যারা দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করবে, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শুধু রাজনৈতিক নেতা নয়, বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত আরও অন্তত ৭৩ জন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছেন। আবেদনকারীদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি ও অন্যান্য দলের সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী, স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। প্রতিটি আবেদন প্রথমে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যাচাই করছে। তদন্ত শেষ হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অনুমোদন সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করবেন।
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ১৪ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জাতীয় সংসদ সদস্য পদপ্রার্থীদের অনুকূলে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স ও রিটেইনার নিয়োগ নীতিমালা–২০২৫’ জারি করে। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই নীতিমালা করা হয়। এই নীতিমালার আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স এবং বেসরকারি সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।
পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ঝুঁকিতে থাকা নেতাদের নিরাপত্তা দেওয়া এখন শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব নয়, এটি একটি বড় রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জ। জনবল ও যানবাহনের সংকট থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। হাদি হত্যাকাণ্ড দেশের রাজনীতিতে যে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে, তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ করা এবং নেতাদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করাই এখন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।
আপনার মতামত জানানঃ